৩৫ বছরপূর্তি ১ জানুয়ারি ; পূর্ণাঙ্গ গঠনতন্ত্র ছাড়াই চলছে ছাত্রদল
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া বিএনপির ভ্যানগার্ড খ্যাত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল পূর্ণাঙ্গ গঠনতন্ত্র ছাড়াই ৩৬ বছরে পা দিতে যাচ্ছে। ১ জানুয়ারি ৩৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের প্রস্ততি নিচ্ছে সংগঠনটি।
১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি গঠিত বিএনপির ছাত্র সংগঠনটি দীর্ঘ সময় পরও কোনো স্থায়ী গঠনতন্ত্র করতে পারেনি। খসড়া গঠনতন্ত্র দিয়ে চলছে সংগঠনের কার্যক্রম। ফলে বিভিন্ন সময় অছাত্র-বুড়ো কখনো সরকারি চাকরিজীবীরাও ছাত্রদলের কমিটিতে পদায়ন হয়েছেন। এ নিয়ে ছাত্রদলের সক্রিয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা যায়। ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা যায়।
গত ১৪ অক্টোবর ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটির অনুমোদন দেন সাংগঠনিক প্রধান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী স্বাক্ষরিত এ কমিটির মোট সদস্য সংখ্যা ২০১।
এর মধ্যে নাম প্রকাশ করা হয়েছে ১৫৩ জনের। এ কমিটির একজনও নিয়মিত ছাত্র নন এবং এর মধ্যে অধিকাংশ নেতাই আবার বিবাহিত। কমিটি গঠনে মানা হয়নি ছাত্রদলের খসড়া গঠনতন্ত্রও। ১২ জন সহ-সভাপতি ও দুইজন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক থাকার কথা। অথচ নতুন কমিটিতে সহ-সভাপতি করা হয়েছে ৩৪ জনকে। তাদের মধ্যে অন্তত ১৪ জন বিবাহিত। আর যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে ৩৫ জনকে। এর মধ্যে ১০ জন বিবাহিত।
ছাত্রদলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সহ-সাধারণ সম্পাদকের পদ পাঁচটি। সেখানে নতুন কমিটিতে করা হয়েছে মোট ২৮ জনকে। যার মধ্যে আটজন বিবাহিত। সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক থাকার কথা সাত জন। কিন্তু করা হয়েছে ২৮ জনকে। এদের তিন জন বিবাহিত। শোনা যাচ্ছে, এ কমিটির পরিধি আরও বাড়তে পারে।
খসড়া গঠনতন্ত্রের ১৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সিনিয়র সহ-সভাপতি, সহ-সভাপতি ১২ জন (কেন্দ্র থেকে ছয় জন, বিভাগীয় ছয় জন), সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক দুইজন, সহ-সাধারণ সম্পাদক পাঁচ জন, সাংগঠনিক, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ছয় জন, প্রচার সম্পাদক, সহ-প্রচার সম্পাদক, দফতর সম্পাদক, সহ-দফতর সম্পাদক ৫৬ জন ও ৯৫ জন সদস্যসহ ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি থাকবে। কিন্তু দেখা যায় বর্তমানে ২০১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।
এ ছাড়া সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীরাই কেবল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সদস্য হতে পারবেন। কিন্তু নতুন কমিটির একজনও নিয়মিত ছাত্র নন।
ছাত্রদলের গঠনতন্ত্রের ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদে আছে, জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হবে। অথচ সম্মেলন ছাড়াই প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়।
এর আগে ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আব্দুল কাদের ভূইয়া জুয়েল সভাপতি ও হাবীবুর রশিদ হাবীবকে সাধারণ সম্পাদক করে দুই বছরের জন্য ছাত্রদলের পাঁচ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। সাত মাস পর ২০১৩ সালের ১৫ এপ্রিল তা পূর্ণাঙ্গ হয়ে কমিটির আকার দাঁড়ায় ২৯১ সদস্যে। ওই কমিটিতেও অছাত্র-বুড়ো, ব্যবসায়ীরা স্থান পায়।
ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মীদের দাবি, ছাত্রদলের কোনো স্থায়ী গঠনতন্ত্র না থাকাই বার বার অছাত্র নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার অন্যতম কারণ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ছাত্রদল পরিচালিত হয় খসড়া গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে। ওই খসড়া গঠনতন্ত্রের ৬-এর ১ অনুচ্ছেদে প্রাথমিক সদস্যপদ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- বাংলাদেশের যে কোনো মাধ্যমিক বা সমমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অধ্যয়নরত প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের উদ্দেশ্য ও আদর্শের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সংগঠনের নিয়ম-কানুন প্রতিপালনে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে সদস্যপদ গ্রহণ করতে পারবে।
ওই অনুচ্ছেদের খ উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- বাংলাদেশের নাগরিক এবং অধ্যয়নরত ছাত্ররাই কেবল মাত্র জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সদস্য হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
বাস্তবতা হচ্ছে- ‘অধ্যয়নরত’ শব্দটির সুযোগ নিয়ে কয়েক বছর আগে ছাত্রত্ব শেষ হওয়া বয়স্করাও সান্ধ্যকালীন অথবা প্রফেশনাল কোনো কোর্সে ভর্তি হয়ে নিজেদের অধ্যয়নরত প্রমাণ করে ছাত্রদলের নেতা বনে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত ছাত্রদলকর্মীদের দাবি ‘অধ্যয়নরত’ বললেই হবে না ‘নিয়মিত’ ছাত্র হতে হবে। তা গঠনতন্ত্রে যুক্ত করতে হবে।
ছাত্রদলের খসড়া গঠনতন্ত্রের ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল’ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের অঙ্গ সংগঠন।
কাজেই ছাত্রদল মূল দলের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করবে। চেয়ারপারসন বিশেষ কোনো প্রয়োজনে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বাতিল কিংবা কেন্দ্রীয় কার্যক্রম স্থগিত করে নতুন পূর্ণাঙ্গ/আহ্বায়ক কমিটি গঠন করতে পারবেন। তিনি যে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। চেয়ারপারসন ছাত্রদলের সংবিধানের যে কোনো অনুচ্ছেদ, ধারা-উপধারা স্থগিত, সংযোজন, বিয়োজন এবং প্রয়োজনে সংবিধান বাতিল করতে পারবেন। এটা অবশ্যই পরির্বতন জরুরি।
কারণ ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির কাউন্সিলের মাধ্যমে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯০-বি/১/বি/৩ ধারা অনুযায়ী দলীয় গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত করা হয়। তা ২০১০ সালে ২১ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে জমা দেয় দলটি। সেই সময় বিএনপির গঠনতন্ত্রে ছাত্রদল ও শ্রমিকদলকে স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে রাখা হয়। গঠনতন্ত্র সংশোধনের দীর্ঘদিন পরও বিএনপি এ সব সংগঠনের নেতৃত্ব থেকে মূল দলের নেতাদের সরাতে পারেনি।
উল্লেখ, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০-বি/১/বি/৩ ধারায় বলা হয়েছে- শিক্ষক, ছাত্র ও বিভিন্ন পেশার সদস্য এবং আর্থিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের সমন্বয়ে রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন থাকতে পারবে না। তবে ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক বা চাকরিজীবীরা নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সংগঠিত হতে পারবে এবং গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক চর্চার জন্য তারা সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবে।
ছাত্রদল নেতাকর্মীরা দাবি করেন, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতির বয়সসীমা ৩০ থেকে ৩২ এর মধ্যে করতে হবে। মহানগর কমিটির ক্ষেত্রে ২৮ থেকে ৩০ বছর। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শাখাগুলো কোনোক্রমে ২৫ বছরের বেশি হবে না। নিয়মিত ও অনিয়মিত ছাত্রদের বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে। কোনো ছাত্র তার রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ অনুযায়ী সর্বোচ্চ দুই বছর ড্রপ দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাকে অনিয়মিত বলা যায়। তবে কেউ প্রাইভেট কিংবা সান্ধ্যকালীন ব্যাচে ভর্তি হয়ে নিয়মিত অথবা অনিয়মিত ছাত্র দাবি করতে পারেন না। এই বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দরকার। তাহলে অনেক ক্ষেত্রে এ সমস্যাগুলো কমে যেত। ছাত্র সংসদ নিবার্চনের মাধ্যমে নেতৃত্ব তৈরি হতো।
১৯৯৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সংশোধিত ছাত্রদলের খসড়া গঠনতন্ত্র দিয়ে সংগঠনের কার্যক্রম প্রসঙ্গে ছাত্রনেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছাত্রদলের গঠনতন্ত্র করা উচিত। যেখানে আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সংগঠন ছাত্রলীগ বয়সের সময়সীমা কমিয়ে ২৫ বছরে নিয়ে আসছে। সেখানে দেশের বৃহৎ ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল এখনো বয়সসীমা নির্ধারণ করতে পারছে না। এটা দুঃখজনক।
ছাত্রদলের সাবেক ছাত্রনেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামছুজ্জামান দুদু দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সব গঠনতন্ত্রই খসড়া থাকে। পরবর্তীতে পাস করে নেওয়া হয়। সামনের বর্ধিত সভায় এটাকে যুগপোযোগী করে নেওয়া হবে। আসলে কোনোটাই স্থায়ী নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নিবার্চন ছাড়া অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে আছে। তাকে আবার রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান সমর্থন দিচ্ছে এ ক্ষেত্রে ছাত্রদলের কিছু সমস্যা থাকতেই পারে। এটা নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই। মাথায় যদি পচন ধরে গোড়াতে পানি দিয়ে তো আর লাভ নেই।’
তবে ১৯৮৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৯০ সালের ১ মার্চ ছাত্রদলের সভাপতির দায়িত্বে থাকা বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ছাত্রদলের স্থায়ী গঠনতন্ত্র নেই, এটা ঠিক নয়। আমার সময় থেকে শুরু করে রিজভী-ইলিয়াস আলী পর্যন্ত ছাত্রদলের কমিটি গঠনতন্ত্র অনুযায়ীই হয়েছে। এরপর আর আমি বলতে পারব না।’
তিনি বলেন, ‘আমার জানা মতে ছাত্রদলের গঠনতন্ত্রকে পরির্বতন পরিমার্জন করা হয়েছে। আর ছাত্রদলের কমিটি বড় করলেই সংগঠন শক্তিশালী হবে এমনটা নয়। তাছাড়া কারা ছাত্রদলের কমিটিতে স্থান পাবেন, এটা ছাত্রদলের গঠনতন্ত্রে স্পষ্ট বলা আছে।’
বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ছাত্রদলের গঠনতন্ত্র খসড়াই থাকবে। এটা চলমান থাকবে। যখন বর্থিত সভা হবে তখন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুগপোযোগী করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ছাত্রদল একটি বৃহৎ ছাত্র সংগঠন। ছাত্র রাজনীতির একমাত্র ধারক হচ্ছে ছাত্রদল।’
ছাত্রলীগের বর্তমান কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে সারাদেশের ছাত্র সমাজ অতিষ্ঠ। ছাত্র সমাজ আজকে ছাত্রদলের ছায়া তলে ঐক্যবদ্ধ।’
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. আকরামুল হাসান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমাদের পরবর্তী বর্ধিত সভায় আলাপ আলোচনা করে বর্তমান যে গঠনতন্ত্র আছে এটাকে ঠিক রেখে কিছু পরিবর্তন আনা হবে। তা অবশ্যই যুগপোযোগী হবে।’ তবে কোন কোন বিষয়ে পরিবর্তন আনা হবে তা তিনি নির্দিষ্ট করে বলেননি। এ ছাড়া কবে নাগাত বর্ধিত সভা হবে তাও তিনি জানাতে পারেননি।
ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটির দফতর সম্পাদক মো. আব্দুস সাত্তার পাটোয়ারি দ্য রিপোর্টকে জানান, ছাত্রদলের ৩৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উদযাপনের প্রস্ততি চলছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২ জানুয়ারির ছাত্র সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে পুলিশ। সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
তিনি জানান, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে সমাবেশের অনুমোদন দেওয়া হয় গত সোমবার সন্ধ্যায় ডিএমপি পুলিশ আমাদের সমাবেশের অনুমতি দেয়।