সাংবাদিকদের জন্য বিষময় বছর
বাকস্বাধীনতা এবং প্রকাশ ও প্রচার স্বাধীনতা সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রমাত্রই তার নাগরিকদের এই স্বাধীনতা দিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
কিন্তু বিভিন্ন আইনী খাত ও অজুহাত দেখিয়ে মানুষের এই মৌলিক স্বাধীনতা হনন করে, এমনকি উন্নত দেশগুলোও।
গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত চলছে কথিত ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও মান’ রক্ষার ঠুনকো অজুহাতে।
২০১৪ সালেও এমন অসভ্যতা দেখা যায়। সংবাদকর্মীদের জন্য বছরটি ছিল ভয়াবহ একটি বছর।
তবে সবচেয়ে বেশী নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের সাংবাদিকরা। আর এরপর উত্তর আফ্রিকার গণমাধ্যমকর্মীরা।
বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরডব্লিউবি) এক পরিসংখ্যানে জানিয়েছে, ২০১৪ সালে বিশ্বে ৬৬ গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী (১৫ জন) নিহত হয়েছে সিরিয়ায়।
প্যারিসভিত্তিক এ সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে গোটা বিশ্বে ১১৯ সংবাদকর্মী অপহৃত ও ১৭৮ সাংবাদিক কারাবন্দী হয়েছেন।
বছরে সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের তথ্য নিয়ে কিছুটা গরমিল লক্ষ্য করা গেছে বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে।
নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) বলেছে, চলতি বছর বিশ্বে ৬০ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংস্থাটি বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, চলতি বছর সবচেয়ে বেশী সাংবাদিক নিহত হয়েছেন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সিরিয়ায়। দেশটিতে এ বছর ১৭ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। আর সর্বশেষ যে সাংবাদিক নিহত হয়েছেন তিনি হলেন— আফগানিস্তানের ক্যামেরা ম্যান জুবায়ের হাতামি।
অন্যদিকে, জেনেভাভিত্তিক প্রেস এমব্লেম ক্যাম্পেইন (পিইসি) নামের একটি সংস্থা বলেছে, ২০১৪ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অন্তত ১২৮ সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। সংস্থাটির মতে, ২০১৪ সালে সবচেয়ে বেশী সাংবাদিক নিহত হয়েছেন ফিলিস্তিনে।
প্রসঙ্গত, সংস্থাগুলোর নিজস্ব গবেষণা পদ্ধতি, সাংবাদিকের সংজ্ঞা, নিশ্চিত কিংবা অনিশ্চিত প্রভৃতি কারণে হিসাবের গরমিল রয়েছে গেছে। তবে হিসাবে গরমিল হলেও তিনটি সংস্থাই ২০১৪ সালকে সাংবাদিকদের জন্য ভয়ঙ্কর বছর বলে উল্লেখ করেছে। চলতি বছর বিশ্বব্যাপী যে সব সাংবাদিক তাদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্য থেকে আলোচিত কয়েকজনের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল—
কামিল্লি লিপেজ
একজন ফরাসী ফটোজার্নালিস্ট। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক বা মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে কাজ করছিলেন। গত ১৩ মে ক্যামেরুন সীমান্তে দায়িত্ব পালনকালে দেশটির বিদ্রোহীদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে পড়ে নিহত হন তিনি। মাত্র ২৬ বছর বয়সেই তিনি বিশ্বমিডিয়ায় নিজের নাম লেখাতে সক্ষম হন। এর আগে কাজ করেছেন দক্ষিণ সুদানে। ২০১২ সালের জুলাই মাসে তিনি মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে চলে যান। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতেন।
মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের রাস্তায় এ্যান্টি-বালাকা বিদ্রোহীদের সঙ্গে হাঁটছেন কামিল্লি লিপেজ। ছবি-বিবিসি, ১৩ মে, ২০১৪
আঞ্জা নিয়েড্রিংকহস
বার্তা সংস্থা এপির (এ্যাসোসিয়েটেড প্রেস) ফটোসাংবাদিক আঞ্জা নিয়েড্রিংকহস। গত ৪ এপ্রিল আফগানিস্তানে পুলিশের ফাঁকা গুলিতে তিনি নিহত হন। এ সময় সহকর্মীর সঙ্গে গাড়িতে বসে ছিলেন তিনি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে হাইস্কুলে পড়া অবস্থায় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৯০ সালে জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুটে ইউরোপিয়ান প্রেস ফটো এ্যাজেন্সিতে ফুল টাইম ফটোগ্রাফার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সাবেক যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধে ১০ বছর কাজ করেন তিনি। ২০০২ সালের নভেম্বরে ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফার হিসেবে এপিতে যোগদান করেন। এপির যে ১১ জন সাংবাদিক ২০০৫ সালে পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন তার মধ্যে একমাত্র নারী ছিলেন আঞ্জা নিয়েড্রিংকহস।
২০০৫ সালে ৭ এপ্রিল ইতালীর রাজধানী রোমে ছবিটিতে পোজ দেন আঞ্জা নিয়েড্রিংকহস। সূত্র : এপি থেকে ইয়াহু নিউজ, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪
বিলাল আহমেদ বিলাল
ফিলিস্তিনী টেলিভিশন চ্যানেল প্যালেস্টাইন টুডের সিরিয়ান প্রতিবেদক ছিলেন বিলাল আহমেদ বিলাল। চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল আসাদ সরকারের কারাগারে তার মৃত্যু হয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলেছে, নিরাপত্তাবাহিনীর নির্যাতনের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ২০১১ সালে তাকে আটক করা হয়। প্যালেস্টাইন টুডে ছাড়াও বেশ কয়েকটি আরবী ভাষার সংবাদ মাধ্যমের প্রদায়ক হিসেবে কাজ করেন তিনি। আটকের আগে বিলাল প্যালেস্টাইন টুডের একটি এ্যাসাইনমেন্টের জন্য লেবানন যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
বিলালের ফেসবুক থেকে ছবিটি নিয়ে প্রকাশ করেছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট নামেরি একটি সংগঠন।
বিলালের ফেসবুক থেকে ছবিটি নিয়ে প্রকাশ করেছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট নামেরি একটি সংগঠন
সদরুল আলম নিপুল
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার বাসিন্দা। স্থানীয় দৈনিক মাথাভাঙা প্রত্রিকার প্রতিবেদক ছিলেন নিপুল। গত ২১ মে জেলার একটি রেলস্টেশন থেকে তার বিভাজিত লাশ উদ্ধার করা হয়। তার পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওইদিন রাতে একটি ফোন পেয়ে তিনি বাইরে যান। তারপর আর ফিরে আসেননি। পরিবারের ধারণা, স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীরা তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। কারণ এর আগে মাদক ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে দৈনিক মাথাভাঙা পত্রিকায় তার প্রস্তুত করা একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এরপর মাদক ব্যবসায়ীরা তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল।
মাদক পাচারকারীদের আক্রোশের শিকার হয়ে জীবন হারান সদরুল আলম নিপুল। গত ২১ মে প্রথম আলোয় ছবিটি প্রকাশিত হয়
অং কিয়াও নাইং
মিয়ানমার তথা বার্মার ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ছিলেন অং কিয়াও নাইং। গত ৪ অক্টোবর দেশটির মন রাজ্যের কিয়াইকমিয়াও শহরের একটি সামরিক কারাগারে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর তাকে আটক করে সেনাবাহিনী। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, তিনি দেশটির কারেন বিদ্রোহীদের পক্ষ নিয়ে কাজ করছেন। হত্যার পর পরিবারকে না জানিয়েই সেনাবাহিনী তার লাশ শহরের পার্শ্ববর্তী একটি জায়গায় কবরস্থ করে। পরে বিষয়টি প্রকাশ হয়।
জার্নালিস্ট ফোরাম আসাম নামের একটি ভারতীয় সংগঠন গত ২৯ অক্টোবর অং কিয়াও নাইংয়ের হত্যার প্রতিবাদ জানায়।
ছবি : গত ২১ অক্টোবর ডেমোক্রেসি অব বার্মা নামের একটি ওয়েবসাইটে ছবিটি ছাপা হয়
তখন সেনাবাহিনীও তাকে গুলি করে হত্যার কথা স্বীকার করে। তবে তার জন্য একটি কারণ দাঁড় করানো হয় যে, এক সেনা সদস্যের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে তিনি পালানোর চেষ্টা করেন। আর এ কারণেই তাকে গুলি করা হয়। ৪৯ বছর বয়সী নাইং মিয়ানমারের ইলেভেন মিডিয়া, ইয়াঙ্গুন টাইমস, দ্য ভয়েসসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রদায়ক হিসেবে ছবি ও প্রতিবেদন সরবরাহ করতেন।
সূত্র : রিপোর্টার্স উইথআউট বর্ডার্স/কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট/প্রেস এমব্লেম ক্যাম্পেইন/আলজাজিরা/বিবিসি/ওয়ার্ল্ডবুলেটিন