রাবির ঘটনাবহুল ২০১৪, শিবিরের বোমাবাজিতে শুরু ছাত্রলীগের মারধরে শেষ
বছরের পালাবদলের নিয়মে এই তো সেদিন চলে গেল ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩।
যথারীতি ২০১৪ সালটি আমাদের মাঝে এলেও এর সূচনা বাংলাদেশের জন্য ভাল ছিল না। প্রথম থেকেই জাতীয় রাজনীতির উত্তাপ গড়িয়েছিল রাজধানী থেকে পাড়া-মহল্লায়। তারই ধারাবাহিকতায় দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও আলোচনায় ছিল ছাত্র সংগঠনগুলো। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল আলোচনায় ছিল ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবির। তবে মাঝেমধ্যেই ঝটিকা কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে বিএনপির অঙ্গসংগঠন ছাত্রদলকেও।
২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহটিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছাত্রশিবিরের বোমাবাজি ও ককটেল বিস্ফোরণের কারণে আতঙ্কে ছিলেন ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীসহ গোটা রাজশাহীবাসী। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী সহিংসতায় পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে এক ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে শিবির। তবে ধীরে ধীরে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশও কিছুটা ভাল হতে থাকে। তবে শিবির বছরের প্রথম দিকে বেশ কিছুদিন আলোচনায় থাকলেও পরে শিক্ষার্থী মারধর করাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে উঠে আসে ছাত্রলীগ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ধিত ফি প্রত্যাহার ও সান্ধ্যকালীন কোর্স বাতিলের দাবিতে ২ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ ও পুলিশ। এ ঘটনায় সাংবাদিকসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।
প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ১১ মার্চ ক্যাম্পাসে মোটরসাইকেলে করে বহিরাগতদের নিয়ে শোডাউন করে ছাত্রলীগ। সিন্ডিকেটের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ আল হোসেন তুহিনের নেতৃত্বে ২৫-৩০টি মোটরসাইকেল ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়কে একটানা হর্ন বাজিয়ে শোডাউন করে।
শিবির সন্দেহে ২৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখশ হলে আব্দুল হান্নান নামের এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে পা ভেঙে দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
আবারও ২৯ মার্চ শরিফুল ইসলাম বাবু নামের এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখদুম হলে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় ওই শিক্ষার্থীর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যার হুমকি দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
৩০ মার্চ চাঁদা না দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে আব্দুল মুহিত ও ইমরান হোসেন নামের দুই শিক্ষার্থীকে রড ও হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আহত করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
অস্ত্র ও গুলিসহ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আকতারুল ইসলাম আসিফ ও গত কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক সুদীপ্ত সালামকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে নেতাকর্মীরা ৩১ মার্চ প্রশাসন ভবনে গিয়ে প্রক্টর অফিসে ভাঙচুর চালান। সেখান থেকে বের হয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে গিয়ে তালা লাগিয়ে দেন।
টোকেন ছাড়া বর্ষবরণ উৎসবের খাবার না দেওয়ায় ১৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক রাহাজুল আমিন হৃদয় নিজ বিভাগের শিক্ষককে হত্যার হুমকি দেন। একই দিন রাজশাহীর বালিয়াপুকুর এলাকায় ছিনতাই করার সময় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা আয়াতুল্লাহ আল বেহেস্তি ও সাদ্দামকে আটক করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি টহল দল।
পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ২৩ এপ্রিল নিজ দলের কর্মী কবির হোসেনকে পিটিয়ে আহত করেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
শিবির সন্দেহে ওয়ালিউল্লাহ নামের এক শিক্ষার্থীকে ২৬ এপ্রিল পিটিয়ে আহত করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
‘পূর্ব প্রস্তুতি’ না থাকায় ১৩ মে অস্ত্র উঁচিয়ে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করে পরীক্ষা বন্ধ করে দেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মেহেদী হাসানসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী।
ছাত্রলীগের গত কমিটির গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক মোবাশ্বির আহমেদ তামিমকে ২২ মে মাদার বখশ হলের ভেতরে ধাওয়া দেয় শিবির। ঘটনার পর হলে পুলিশ গিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে তল্লাশী চালায়।
মতিহার থানায় আটক বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের দুই নেতাকে নিয়ে ২৬ মে অভিযান পরিচালনার সময় শিবিরের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। এতে পুলিশের এক এসআইসহ তিন পুলিশ সদস্য আহত হন।
জাহিদ হাসান বাবু নামের এক লন্ড্রিম্যানকে ২৭ মে পিটিয়ে আহত করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় শিবির নেতা রাসেল আলমের পা কর্তনের প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে ডাকা ধর্মঘটে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন শিবিরকর্মীরা। ২০ জুন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সামনে এ ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ধর্মঘটে ক্লাস-পরীক্ষা বিঘ্নিত করতে একাডেমিক ভবনগুলোর তালায় সুপার গ্লু আঠা দিয়ে আটকে দেয় শিবির। ওই দিন ক্যাম্পাসের প্রধান ফটক ও নগরীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি বাস ভাঙচুর করেন তারা। ক্যাম্পাসে আতঙ্ক ছড়াতে একাধিক হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
ছাত্রলীগকর্মীদের কাছে ৪ জুলাই ইফতার পার্টি উপলক্ষে টাকা চাওয়ায় স্বেচ্ছায় রক্তদাতা সংগঠন ‘বাঁধন’ এর নেতাকর্মীদের মারধর করেন ছাত্রলীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন।
প্রেমঘটিত দ্বন্দ্বের জের ধরে ৭ জুলাই এক ছাত্রীকে মারধরের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ওবায়দুল হক কায়েসকে বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রে সুপারিশ করেন সংগঠনটির রাবি শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
রাবি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আতিকুর রহমান ও সাংগঠনিক সম্পাদক কাওসার আহমেদ কৌশিক ১৫ জুলাই পূর্ব শত্রুতার জের ধরে মারামারি করেন। এতে দুই নেতাই গুরুতর আহত হন।
শরীরে ব্যাগ লাগায় ৯ আগস্ট কামরুল হাসান নামের এক শিক্ষার্থীকে পেটান ছাত্রলীগের দুই নেতাকর্মী।
ছাত্রলীগের হাতে ১২ আগস্ট মারধরের শিকার হন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরে তাকে মারধর করেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক কাজী আমিনুল ইসলাম লিঙ্কনসহ কয়েকজন নেতাকর্মী।
বান্ধবীকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় ১৪ আগস্ট ইফতি শাহরিয়ার নামের এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
বান্ধবীকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় ১৫ আগস্ট এক শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় আটক দুই ছাত্রলীগকর্মীকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়। এর আগে অস্ত্র মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে রাজশাহী মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে সোপর্দ করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে আসা এক শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে ১৯ আগস্ট মুক্তিপণ চাওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ছাত্রলীগের দুই কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়। একই অপরাধে ছাত্রলীগের অপর দুই নেতাকে বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রে সুপারিশ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া বেশ কিছুদিন জেল খাটেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী সিরাজুম মুনীরকে ২৮ আগস্ট মারধর করে মাথা ফাটিয়ে দেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম তৌহিদ আল হোসেন তুহিন। পছন্দের ব্যক্তিকে কাজের টেন্ডার না দেওয়ায় ছাত্রলীগ সম্পাদক এ ঘটনা ঘটান বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। পরে এ ঘটনায় তুহিনকে সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এই ঘটনায় ছাত্রলীগের তিন নেতাকর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
তারিকুর রহমান বাবু নামে এক ছাত্রলীগ নেতাকে ২১ অক্টোবর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে দুর্বৃত্তরা।
ছাত্রলীগের উপ-দফতর সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুনকে ১২ নভেম্বর ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত করে দুর্বৃত্তরা।
ক্যাম্পাসে ১৫ নভেম্বর পাল্টাপাল্টি মিছিল-শোডাউন করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগ।
সর্বশেষ ২৬ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আব্দুল লতিফ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক বিশ্বনাথ শিকদারকে চাপাতি নিয়ে মারতে যান ছাত্রলীগকর্মী মুহম্মদ হাফিজ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি সোহরাব হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘যারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করে, তারা সরকার তথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনরে মদদপুষ্ট। এ কারণে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হাতে শিক্ষার্থীরা যৌন নির্যাতন ও মারধরের শিকার হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহম্মদ মিজানউদ্দিন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। কিন্তু এর পরও কেউ যদি মারধর বা অন্য কোনো হয়রানির শিকার হয়ে লিখিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করে, তাহলে অবশ্যই দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনা ঘটলেও শিক্ষার্থীরা লিখিতভাবে কোনো অভিযোগ করছে না।’