দুঃখ আর কান্নার মধ্যেই কেটে গেল বছরটি
আরো একটি বছর পেরিয়ে গেল। মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেল ২০১৪ সাল। সময়, কাল ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিল একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের চতুর্থ বছরটি। মহাকালের প্রেক্ষাপটে ৩৬৫ দিন এমন কোনো সময় নয় বটে কিন্তু দেশ, জাতি, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্ববাসীর কাছে একটি বছর নেহায়েত কম সময় নয়।
বহু ঘটনার কালসাক্ষী হয়ে রয়েছে ২০১৪ সাল। বহু ঘটনাপ্রবাহ ব্যক্তি তথা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এমনকি বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষ হিসাব মেলাচ্ছে কী পেলাম, কী পেলাম না। সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে চলছে হিসাব-নিকাশ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, পুরো বছরটি নানারকম অস্থিরতায় কেটেছে। ২০১৪ সালের শুরুতেই ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা, যে কারণে পুরো দেশ অচল হয়ে গিয়েছিল। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অস্থিতিশীল রাজনতিক অবস্থার মধ্যেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলীয় জোট ৫ জানুয়ারি নির্বাচন করে। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট সে নির্বাচন বর্জন করে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন দলগুলো নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় থাকে। নির্বাচনপূর্ববর্তী যে অচলাবস্থা ছিল, অলৌকিকভাবে নির্বাচনপরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল হয়ে আসে। ২০ দলীয় জোট তাৎক্ষণিকভাবে ব্যর্থ হয়। এতকিছুর পরও রাজনৈতিক অবস্থা যে স্বাভাবিক ছিল, তা বলার কোনো অবকাশ নেই।
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়মী লীগ সরকার গঠন করে। কিন্তু দেশ সুষ্ঠু, সুন্দরমতো ও সঠিকভাবে পরিচালনা করেছে, তা বলার কোনো সুযোগ নেই। নানারকম অস্থিরতায় কেটেছে পুরো বছর। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটেই ভাল ছিল না। প্রতিনিয়ত স্বর্ণ চোরাচালান, খুন, হত্যা ধর্ষণ, লুটপাট, ব্যাংকের আর্থিক কেলেঙ্কারি, অনিয়ম, দুর্নীতিতে ছেয়ে গিয়েছিল। পার হয়ে যাওয়া বছরটিতে আলোচিত বিষয় ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। যুদ্ধাপরাধীদের অনেকেরই বিচারে ফাঁসির রায় হয়েছে।
সামাজিক বিশৃঙ্খলা বহুগুণে বেড়েছে। সামাজিক অপরাধ বিশেষ করে সর্বনাশা ইয়াবাসহ নানারকম নেশাজাতীয় ওষুধ তরুণসমাজকে নষ্ট করে দিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় সারাদেশের মানুষ বিচলিত হয়েছেন। এ জঘন্য হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা করতে পারেনি সরকার।
অর্থনীতিতে কিছু সাফল্য এসেছে বটে কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে অর্ধলক্ষ কোটি টাকা অলস অবস্থায় পড়ে রয়েছে। পাশাপাশি বহু তরুণ-তরুণী বেকার রয়েছে, কর্মসংস্থান হচ্ছে না।
ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছে। ক্রিকেটে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে সিরিজ জয় করেছে।
২০১৪ সালের শুরুতেই রাজনৈতিক অবস্থা যেমন খারাপ ছিল, ঠিক ২০১৫ সালের প্রথম দিনেই হরতাল দিয়ে শুরু হচ্ছে। ফলে স্বাগত বছরটি কেমন যাবে, তা নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারেন না। নতুন বছরটিও যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল হবে না, তা নিশ্চিত নয়। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট এক দাবিতে অনড় অবস্থায় রয়েছে। তারা দলীয় সরকারের পরিবর্তে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। বর্তমান সরকার এদিকে দৃষ্টি দেবে নাকি ২০১৯ সালে নির্বাচন করবে, তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করে শুধু এটাই বলা যায়, সাধারণ মানুষকে হয়তো কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে দিন পার করতে হবে।
২০১৪ সালে ভারতের রাজনীতিতে পরিবর্তন হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মাধ্যমে বিজেপি সরকার গঠন করেছে। চরমপন্থী ও হিন্দুত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহুল আলোচিত গণতান্ত্রিক দেশখ্যাত ভারতে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী কৈলাস সত্যার্থী দেশটির সম্মান বৃদ্ধি করেছেন।
উপমহাদেশের রাজনীতি মোটেই শান্তিপূর্ণ ছিল না। বিশেষ করে পাকিস্তানের রাজনীতি ছিল টালমাটাল অবস্থায়। আফগানিস্তানের মতোই পাকিস্তানে তালেবানরা বিভিন্ন প্রদেশে সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ ছাড়া পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রাদেশিক দ্বন্দ্ব, সংঘাত, রক্তক্ষয় ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ২০১৪ সালের শেষদিকে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী পরিচালিত একটি স্কুলে তালেবানরা হামলা করে। ওই ঘটনায় ১৫০ জন মানুষ প্রাণ হারায়। তার মধ্যে শিশুদের সংখ্যাই ছিল বেশী।
সাফল্যের বিচারে এ দেশটির ১৭ বছরের তরুণী মালালা ইউসুফজাই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে।
বিশ্ব রাজনীতিতে চীন একটি মহাশক্তিধর রাষ্ট্র। সমাজতান্ত্রিক এ রাষ্ট্র সম্পর্কে বেশী কিছু জানার সুযোগ নেই। শুধু এটাই বলা যায়, অর্থনীতিতে মহাশক্তিধর যুক্তরাষ্ট্রকে পিছু হটিয়ে দিয়ে শীর্ষে উঠে এসেছে দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ ১৩ বছর আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে ইতি টেনেছে। মহাশক্তিধর এ রাষ্ট্রটি অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠেছে।
জার্মানী, ফ্রান্স, ইতালী, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বহু দেশেই প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে।
নতুন করে সঙ্কটে পড়েছে রাশিয়া। ক্রিমিয়া দখলকে কেন্দ্র করে রাশিয়াবিরোধী মনোভাব জেগে ওঠে পশ্চিমা বিশ্বের রাজনীতিবিদদের মধ্যে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবরোধ গড়ে তোলে তারা।
২০১৫ সাল কেমন যাবে তা কেউই নিশ্চিত নন। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি কীভাবে পরিচালিত হবে, তা কেউই বলতে পারেন না। অনেক জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন বটে, সেটা নিছক ধারণামাত্র। শতভাগ নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। তবুও মানুষ আশা নিয়ে বেঁচে থাকে।