সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির শক্ত অবস্থান চায় শরিকরা
আগামী ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় জোট সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলন ঘোষণা করেছে। কিন্তু অতীতের মতো আন্দোলনের সফলতা নিয়ে সংশয় থাকলেও এবার আন্দোলনের মাঠে বিএনপির অগ্রণী ভূমিকা ও শক্ত অবস্থান চান শরিক দলের নেতারা।
জোটের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য রিপোর্টকে জানান, বিএনপি ২০ দলের চালিকাশক্তি ও প্রধান দল। অতীতে সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে দলটির শীর্ষ নেতাদের রাজপথে পাওয়া যায়নি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে এবং আওয়ামী সরকারের পতন আন্দোলনে যখন বিএনপি তথা জোটের নেতাকর্মীরা সারাদেশে আন্দোলনকে চূড়ান্ত অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিল, তখন ঢাকায় বিএনপির সিনিয়র ও দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা নিজেদের আড়ালে রেখেছেন।
ঢাকার রাজপথে তাদের দেখা মেলেনি। সারা দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিলেও শুধু ঢাকায় নেতারা রাজপথে না থাকার কারণে আওয়ামী লীগ জোর করে ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচন করে ‘অবৈধভাবে’ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘অতীতে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। সরকারের দলনপীড়ন সত্ত্বেও আমরা রাজপথে ছিলাম এবং আছি। কিন্তু বিএনপিকে সেভাবে পাওয়া যায়নি। বিএনপি মাঠে থাকলে ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরপরই আওয়ামী লীগ আরেকটা নির্বাচন দিতে বাধ্য হতো।’
তিনি বলেন, ‘এবার সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপিকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। পিঠঝাড়া দিয়ে তাদের রাজপথে নামতে হবে। খালেদা জিয়া চূড়ান্ত আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। কিন্তু, আন্দোলন তো শুধু ডাক দিয়ে হয় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিএনপি নেতাদের ঘুম এখনও ভাঙেনি। মামলা-হামলার ভয়ে ঘরে বসে থাকলে তো চলবে না। আওয়ামী লীগকে যত বেশি সময় দেওয়া যাবে, তারা ততবেশি স্বৈরাচারী হয়ে উঠবে। ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে তারা প্রশাসনসহ পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাজে লাগাতে নানা কৌশলের আশ্রয় নেবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জোটের মধ্যম সারির এক দলের নেতা বলেন, ‘আন্দোলন চূড়ান্ত অবস্থায় নিতে হলে বিএনপিকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের মধ্যে এখনও অনৈক্যের সুর। কেন জানি দল অগোছালো। এমপি-মন্ত্রী হওয়ার জন্য বিএনপিতে যে ধরনের প্রতিযোগিতা, আন্দোলনের মাঠে নামতে কিন্তু তাদের সে প্রতিযোগিতা দেখা যায় না।’
২০ দলের শরিক ধর্মভিত্তিক একটি দলের নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সারা দেশে নির্বাচনী ৩০০টি আসন রয়েছে। যখন নির্বাচনী হাওয়া বয় তখন বিএনপি নেতারা এমন তোড়জোড় শুরু করেন, যেন ৩০০ আসন নয়, তাদের ৩৫০ আসন হলেই ভালো। তখন আর জোটের কথা মনে থাকে না। জোটের শরিকদের তারা তখন ভাসমান-অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। এভাবে তো হবে না। খালেদা জিয়াকে জোটের হিসেব নিকেশটাও ক্লিয়ার করতে হবে। জোটের শরিকদের যার যার প্রাপ্য রয়েছে তা আগেই বুঝিয়ে দিলে ভালো হয়।’
এ ব্যাপারে ২০ দলের শরিক জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দেশের জনগণ, মাঠ ও মাটিতে প্রস্তুত। তারা একটা পরিবর্তন চায়। কিন্তু নেতাদের ঘর থেকে বের হয়ে জনতার কাতারে শামিল হতে হবে। ঘরে বসে হাক ডাক দিলে কিছুই হবে না।’
তাহলে কী বিএনপি বা জোটের নেতারা ঘরে বসেই হাক ডাক দিচ্ছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘না। আমি সেটা বলতে চাই না। তবে, সবাইকে আরও বেশি করে মাঠে নামতে হবে। এখন নেতাদের জন্য ঠিকানা হলো দুইটা। একটা রাজপথ আরেকটা জেলখানা। এর মাঝখানে আর কোনো ঠিকানা হতে পারে না ম্যাডামের। হয় তিনি রাস্তায় থাকবেন, না হয় জালিমশাহীরা তাকে জেলখানায় পাঠিয়ে দেবে।’
৫ জানুয়ারি নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি জোট পুরোপুরি ব্যর্থ নয় উল্লেখ করে শফিউল প্রধান বলেন, ‘জনতা কীভাবে সাড়া দিয়েছে সারা পৃথিবী দেখেছে। ওই নির্বাচনে ৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। জনগণ নির্বাচন ভণ্ডুল করে দিয়েছিল। কিন্তু তখনও একটা সংকট দেখা দিয়েছিল নেতাদের মাঠে পাওয়া যায়নি।’
চলমান আন্দোলনে সাড়া মিলবে কী না? জানতে চাইলে জাগপা সভাপতি বলেন, ‘আমি নিজেও মাঠে আছি। বিশ্বাস করি, জোটের সবাই যারা পরিবর্তন চায়, যারা আগামী দিনে জনতার রায় নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায় তাদের একটু ঝুঁকি নিতেই হবে। এ ব্যাপারে আমি প্রস্তুত, অন্যদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে।’
৩ ও ৫ জানুয়ারিতে সরকার সমাবেশের অনুমতি না দিলে জোটের করণীয় কী হবে-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এ সরকারকে বৈধ মনে করি না। এটা দখলদার সরকার তাই তাদের কাছে অনুমতির ব্যাপারটা আন্দোলনের সময় বিবেচনাপ্রসূত নয়।’
বিএনপি শুধু নয়, জোটের শরিকরাও তো ঠিকমতো রাস্তায় দাঁড়ায় না। সুতরাং সবাইকেই রাস্তায় দাঁড়ানো উচিৎ।’
২০ দলের শরিক বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি বলেন, ‘আন্দোলনটা হলো একটা চেষ্টা। সফলতার নিশ্চয়তা নিয়ে তো আর আন্দোলনে কেউ নামে না। যারা ক্ষমতায় থাকার জন্য এ ধরনের ফ্যাসিস্ট মনোভাব নিয়ে হয়রানি মামলা-ভয়ভীতি দেখায় ইতিহাস সাক্ষী এভাবে ক্ষমতায় থাকা যায় না। আন্দোলন সফলের ব্যাপারে আমাদের শতভাগ চেষ্টা থাকবে।’
জোটে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জোট হওয়ার পর থেকে হয়ত প্রশ্ন থাকতে পারে যে ঠিকমতো সমন্বয় হয়নি। কিন্তু জোটের মূল লক্ষ্য ঠিক আছে।’
জোটের আরেক শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব শাহাদত হোসেন সেলিম বলেন, ‘আগে যা হয়েছে হয়েছে। আগামী দিনে সবাই একসঙ্গে সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে মাঠে নামবেন বলেই বিশ্বাস। আগামী দিনের আন্দোলন সফল হবে বলেও আমি মনে করি।’
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমান বলেন, ‘সরকারবিরোধী আন্দোলন চলমান রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে সরকারের সব ব্যর্থতা ও কেলেঙ্কারি জনগণের মধ্যে তুলে ধরতে পেরেছি। দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আগামী দিনের সব কর্মসূচিতে ২০ দলের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করবে এবং তা সফল হবে বলে আমরা আশাবাদী।’
ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী বলেন, ‘অতীতে যা হওয়ার হয়েছে। আগামী দিনে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সবাই মাঠে থাকবেন এবং সে আন্দোলনে অবৈধ এ সরকারের পতন ঘটবে বলে আমাদের বিশ্বাস।’
অতীতের আন্দোলন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়নি দাবি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল(অব.) মাহবুবুর রহমানের।
তিনি বলেন, ‘জনগণও অনৈতিক এ সরকারকে চায় না। ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্রের জন্য একটি কালো দিবস। দিনটি উপলক্ষে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে ঢাকায় সমাবেশ করার কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি। অতীতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে জোট নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নেবে এবং তা সফল করে তুলবে বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি আশাবাদী।’
সরকার আগামী ৩ ও ৫ জানুয়ারি ঢাকায় ঘোষিত সমাবেশ করতে না দিলে কী ভূমিকা থাকবে জোটের— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যদি সরকার এ কর্মসূচিতে বাধা দেয় তাহলে আমাদের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তো আগেই বলে রেখেছেন তিন দিনের টানা হরতাল দেওয়া হবে।’