জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগে সংলাপের অনেক চেষ্টা করেছি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সংলাপের অনেক চেষ্টা করেছি। সংবিধানের মধ্যে থেকে নির্বাচন করতে যতটুকু সম্ভব ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলাম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বানচাল করতে বিএনপি-জামায়াত দেশের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল।
সোমবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে শেখ হাসিনা এ সব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচন বানচাল ও যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে বিএনপি-জামায়াত জোট সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা শত শত গাড়িতে আগুন দিয়েছে এবং ভাঙচুর করেছে হাজার হাজার গাড়ি। মহাসড়কসহ গ্রামের রাস্তার দু’পাশের হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলেছে। পুলিশ-বিজিবি-আনসার-সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ২০ জন সদস্যকে হত্যা করেছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনের আগে আমরা সংলাপে বসার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। সংবিধানের আওতায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমরা সব ধরনের ছাড় দিতে চেয়েছিলাম। নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধানে অনির্বাচিত সরকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। আমাদের শুধু একটাই দাবি ছিল, সংবিধানের মধ্য থেকে আমরা নির্বাচন করতে চাই। সেখানে যত ধরনের ছাড় দেওয়া সম্ভব তা দিতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম। বিএনপি-জামায়াত জোট চেয়েছিল দেশে একটা অরাজক এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে। অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পেছনের দরজা দিয়ে তারা ক্ষমতায় যেতে চেয়েছিল। কিন্তু দেশের মানুষ তাদের সেই ষড়যন্ত্রের পাতানো ফাঁদে পা দেননি।’
তিনি বলেন, ‘২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে পাঁচ বছর দেশ পরিচালনা করেছি। এমন এক অবস্থায় আমরা সরকার গঠন করেছিলাম যখন সমগ্র বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং চরম খাদ্যাভাব চলছে। এ পরিস্থিতিতে আমরা দায়িত্বভার গ্রহণ করে সমাজের সকল স্তরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনি। মানুষের মাঝে আস্থা ও বিশ্বাস সঞ্চার করি। নবউদ্যোমে দেশ গড়ার কাজে মানুষকে সম্পৃক্ত করি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সামগ্রিক উন্নয়ন, সংবিধান ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত রাখার ক্ষেত্রে ২০১৪ সাল বাঙালী জাতির ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল বছর। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গত বছর ছিল বাংলাদেশের জন্য সাফল্যের বছর।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের গৃহীত উন্নয়ন পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের ফলে গত মেয়াদের পাঁচ বছর এবং এই মেয়াদের প্রথম বছরে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিশ্বের সামনে রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া পাঁচটি দেশের একটি হচ্ছে বাংলাদেশ।’
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে বাংলাদেশ ছিল খাদ্যঘাটতির দেশ। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশ আবারও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছিল। দেশে বর্তমানে শিক্ষার হার ৬৯ শতাংশ। এ বছরের পহেলা জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের মাঝে ৩২ কোটি ৬৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯২৩টি বই বিতরণ করা হয়েছে।’
বর্তমান সরকারের আমলে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৬৬.৫ বছর, যা এখন বেড়ে ৭০ বছর হয়েছে বলেও বক্তব্যে বলেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, গত ছয় বছরে আমাদের নিরলস প্রচেষ্টায় ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা।
নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকার নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ঘোষণা করেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। বেতনসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি ৪ মাস থেকে ৬ মাসে বৃদ্ধি করা হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে এই প্রথম নারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২৭ লাখ ২২ হাজার ৫০০ জন বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা ও বয়স্ক মানুষ প্রতি মাসে ৪০০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন।’
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব নিয়ে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করি, ফলে দেশে দুর্নীতি অনেক কমে এসেছে।’
‘বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশ ছিল বাক-স্বাধীনতা হরণের দেশ, সাংবাদিক নির্যাতনের দেশ’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে মিডিয়া এখন পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। বর্তমান সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার নতুন ৩২টি টেলিভিশন, ২২টি এফএম রেডিও এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিও চ্যানেলের অনুমোদন দিয়েছে। তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন ও তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আবারও অস্থিতিশীলতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যাকারী, রাজাকার-আলবদরদের বিচারের কাজ এগিয়ে চলছে। রায় কার্যকর করা হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ আমরা সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করব।’
তিনি বলেন, ‘এই বিচার বানচাল করতে, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে অন্ধকারের অপশক্তি যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, জনগণের মঙ্গল চায় না তারা আবারও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারের চেষ্টা করছে।’
৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপির নির্বাচনে অংশ না নেওয়াটা ছিল একটি রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত। তাদের এই রাজনৈতিক ভুলের খেসারত কেন জনগণকে দিতে হবে? বিএনপি নেত্রীকে আমি আহ্বান জানাচ্ছি- নাশকতা, মানুষ হত্যা, বোমা-গ্রেনেড হামলা, অগ্নিসংযোগ, জানমালের ক্ষতি করা বন্ধ করুন। আপনার ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে আজ আপনি ও আপনার দল সংসদে নেই। আপনি কাকে দোষ দেবেন? আপনার নিজেকেই দোষ দিতে হবে।’
খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘নাশকতার পথ পরিহার করে শান্তির পথে আসুন। দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য কী কী করতে চান তা মানুষকে জানান। নিজের দলকে গড়ে তুলুন। তাহলেই হয়ত ভবিষ্যতে সম্ভাবনা থাকবে। যে পথে আপনি চলছেন তা জনগণের কল্যাণ বয়ে আনবে না। বরং মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা আরও হারাবেন।’
‘মানুষ নিরাপত্তা চায়, শান্তি চায়, উন্নতি চায়’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা অসুস্থ রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। যে রাজনীতি দেশের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য সেই রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চাই।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দিয়েছিলাম, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করব। তার পূর্বেই আমরা সেটা করতে পারব। ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দিয়েছি, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হবে। আমরা এ লক্ষ্য পূরণে সফল হব।’
ভাষণের শেষদিকে তিনি বলেন, বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে। বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবেন। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা আমরা গড়ে তুলব।