উন্নয়নের খাতিরে ভিন্নমতকে দমন করবে সরকার
বাংলাদেশের সামষ্টিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ভিন্নমত বা দ্বিমতকে কঠোর হাতে দমন করবে সরকার। বাংলাদেশকে যে কোনো মূল্যে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম সারির এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সারির দেশে উন্নীত করতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। প্রয়োজনে বড় রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করতেও পিছু হটবে না সরকার। সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা এবং সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ থেকে এই ধারণা পাওয়া গেছে।
সরকারের একাধিক নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বাংলাদেশকে মর্যাদাশীল এবং উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে ‘উন্নয়ন কাজে’র প্রতিই সরকারের সর্বদা নজর থাকবে। ‘উন্নয়ন কাজে’ বিঘ্ন ঘটে এমন কোনো ঘটনা মেনে নেওয়া হবে না। পাশাপাশি বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির নির্বাচনের দাবি কখনোই মেনে নেবে না ক্ষমতাসীনরা। বর্তমান সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হলেই সাংবিধানিক নিয়মে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সোমবার রাত ৭টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও এই আভাস পাওয়া গেছে।
‘উন্নয়ন কাজ’ এগিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে দেশবাসীর সহযোগিতা চেয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘নাশকতার পথ পরিহার করে শান্তির পথে আসুন। আপনার রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আজ আপনি এবং আপনার দলের জাতীয় সংসদে কোনো প্রতিনিধিত্বই নেই। আপনি কাকে দোষ দিবেন। আপনার নিজেকেই দোষ দিতে হবে। নিজের দলকে গড়ে তুলুন। তাহলেই হয়তো ভবিষ্যতে সম্ভাবনা থাকবে। আপনি যে পথে হাঁটছেন তা কল্যাণ বয়ে আনবে না। বরং মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস হারাবেন।’
আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা নিশ্চিত করে জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন কঠোর আন্দোলনে গেলে এবং জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি বন্ধ না করলে বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হবে সরকার।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা এবং জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার করা হবে বেগম খালেদা জিয়াকে। এই দুইটি মামলায় সরকার চাইলে যে কোনো সময় বিএনপি চেয়ারপারসনকে গ্রেফতার করতে পারবে। কেননা, গ্রেফতার না করা সংক্রান্ত এই দুইটি মামলার সকল ফাঁকফোকর উচ্চ আদালত থেকে খারিজ হয়ে গেছে। সরকারের একটি মহল এই দুইটি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসনকে গ্রেফতারের জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র প্রস্তুত করে অপেক্ষা করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবুজ সংকেত পেলেই তা বাস্তবায়ন হবে।
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানান, পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের বৈধতা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলের স্বীকৃতি নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল, তা কেটে গেছে। গত এক বছরে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন আসরে বাংলাদেশের ১৪টি পদ লাভই পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের বৈধতার প্রমাণ দেয়। এ ছাড়া ওই নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো রাষ্ট্র বা দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কেও অবনতি ঘটেনি। বরং বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও জানান, উন্নয়নের স্বার্থে এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশ পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে ‘পূর্ব দিকের দেশ’র (বিশেষ করে চীন) প্রতি বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।
কূটনীতিকরা বলছেন, পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের পর চীন, ভারত এবং জাপান মূলত বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারকে পথ চলতে সহযোগিতা করছে। চীন এবং জাপান বড় ধরনের আর্থিক সহযোগিতা করছে। ভারতও আন্তঃদেশীয় সকল সমস্যা সমাধানে এখন পর্যন্ত ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে।
কূটনীতিকরা আরও বলছেন, বাংলাদেশ মূলত এখন চীন জ্বরে আক্রান্ত। উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ চীনকে অনুসরণ করছে। এ জন্য বর্তমান সরকার উন্নয়নের কথা বলে যে কোনো ভিন্নমত বা দ্বিমতকে কঠোর হাতে দমন করার নমুনা দেখা যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ন্তজাতিক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘ভিন্নমত বা দ্বিমতকে দমন করে গণতন্ত্র চলতে পারে না। চীন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হলেও তাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা হয়। গণতন্ত্রের মাধ্যমে চীনের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা নির্বাচন করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কাঠামো আছে কিন্তু দলগুলোর মধ্যে তার চর্চা নেই। দলগুলো পরিবারতন্ত্রের চর্চায় অভ্যস্ত। কিন্তু গণতন্ত্রের চর্চা না করলে অস্থিরতা থামবে না। সবগুলো দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচন যতদিন পর্যন্ত না হবে ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’