‘স্বল্পমেয়াদে আ’লীগ, দীর্ঘমেয়াদে বিএনপির জয়’
৫ জানুয়ারি পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে স্বল্পমেয়াদে আওয়ামী লীগ জিতলেও দীর্ঘমেয়াদে বিএনপির জয় হয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ দিনকে আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ আর বিএনপির ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। এ দিবস পালন করতে গিয়ে সহিংসতায় সারাদেশে খুন হয়েছে ৪ জন। আহত হয়েছেন ৫ শতাধিক। আটক হয়েছেন সহস্রাধিক।
বিএনপি নেত্রী তার কর্মসূচি সফল করতে না পারায় আপাতদৃষ্টিতে আওয়ামী লীগের জয় বলে মনে হলেও এ ঘটনা দীর্ঘমেয়াদে আওয়ামী লীগের ক্ষতির কারণ হতে পারে। এর ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক আচরণ নিয়ে জনমনে বিরূপ বার্তা যাবে, যা আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তিতে চরম আঘাত হানবে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট, বাম সংগঠনসমূহসহ ইসলামী দলগুলোর বর্জনের মধ্যেও আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করে। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিন্দ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত এমপিদের নিয়ে ৬ জানুয়ারি সরকারও গঠন করে আওয়ামী লীগ। বিএনপি জোট ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের বাধার কারণে তা পারেনি। ফলে শতাধিক লোকের প্রাণহানির মধ্যেও ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এই দিনটিকেই আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ ও বিএনপি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে প্রথমবারের মতো পালন করল।
২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি ছিল ‘সেই নির্বাচনের’ প্রথম বার্ষিকী। দিনটিকে আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার কারণে সরে আসে। তবে বিএনপি প্রশাসনের বাধাকে উপেক্ষা করেই ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। কিন্তু পুলিশ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ে তালা লাগিয়ে ও পিপার স্প্রে ছড়িয়ে খালেদা জিয়াকে বের হতে বাধা দেয়।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে কোনো সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সমাবেশে আসতে বাধা দেওয়ার নজির থাকলেও গেটে তালা দেওয়াটা ছিল নজিরবিহীন, যা বিশ্ব গণমাধ্যম অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে তুলে ধরেছে। সরকারের এমন আচরণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কি বার্তা যাবে, তা এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি একদিন সমাবেশ করলে নিশ্চয়ই সরকারের পতন হতো না। বরং ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচিত সরকার নিজেদের হারানো ইমেজ কিছুটা হলেও উদ্ধারের সুযোগ পেত। অন্যদিকে বিএনপির সমাবেশের আগেও নাশকতাকেও গণতান্ত্রিক আন্দোলন মনে করছেন না তারা।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শেখ হাসিনা সরকারের এমন আচরণের ফলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন নিয়ে বিএনপি যে অস্বস্তির মধ্যে ছিল তা কেটে গেল। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের এক মাসের মাথায় বিএনপি ক্ষমতায় ছাড়তে বাধ্য হলেও আওয়ামী লীগ জবরদস্তি করে ক্ষমতায় থাকছে। অন্যদিক তরুণ প্রজন্মের কাছে আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বচ্ছ ইমেজ আর বিএনপির ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেওয়া তকমা থাকলেও এবারের ঘটনায় তা মুছে যাবে, যা দীর্ঘমেয়াদে বিএনপির জন্য ভাল ও আওয়ামী লীগের জন্য নেতিবাচক ফল নিয়ে আসতে পারে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে তালাবদ্ধ করে রাখা, সারাদেশে লাশ, মিছিলে গুলি, ঢাকায় বছরে প্রথমবারের মতো সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি এ সব কর্মকাণ্ডে আসলে কে জয়ী হলো? বিএনপি না-কি আওয়ামী লীগ। না-কি বিএনপি আওয়ামী লীগ উভয় দল জয়ী হলেও গণতন্ত্রের পরাজয় ঘটল—এমন প্রশ্ন রাজনীতিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমীন বেপারি বলেন, ‘দেশে তো এখন গণতন্ত্র নেই। বিএনপি আরেকটি নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। এটা তো তাদের গণতান্ত্রিক দাবি। কিন্তু সরকার যেভাবে বিএনপিকে দমন করছে তা চরম গণতান্ত্রিক। আজকের যে ঘটনা ঘটল তাতে আওয়ামী লীগের জন্য কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে থাকবে। আসলে গণতন্ত্রই এখন হুমকির মুখে। সরকারের উচিত বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপির উচিত সকল গণতান্ত্রিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নতুন কর্মসূচি নেওয়া। আওয়ামী লীগের উচিত বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসা। তা না হলে দীর্ঘমেয়াদে আওয়ামী লীগের জন্য চরম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিএনপি লাভবান হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ফেরদৌস হোসাইন বলেন, একটা সময় আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে যাওয়ায় এক প্রজন্মের সমর্থন হারিয়েছিল। ফলে দলটিকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকতে হয়েছে। এবারো যদি কোনো কারণে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয় বা ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয় তাহলেও দলটিকে একটি প্রজন্মের সমর্থন হারানোর আশঙ্কা থেকে যায়। সে কারণে দলটিকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকতে হতে পারে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘৫ জানুয়ারি গণতন্ত্রের বিজয় দিবস। বিএনপি অনেক চেষ্টা করেছে গণতন্ত্রকে হত্যা করার জন্য। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে তারা সারাদেশে আগুন জ্বালিয়েও নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে ব্যাহত করতে পারেনি। তারা দেশকে থাইল্যান্ডের মতো পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা গণতন্ত্র রক্ষা করেছি। এ জন্য আমরা গণতন্ত্রের বিজয় দিবস হিসেবে পালন করি। অন্যদিকে বিএনপি গণতন্ত্র হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে এ দিনকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে পালন করতে চায়। আমরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেঁচে থাকতে গণতন্ত্রকে হত্যা করতে দিব না।’
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আজকে প্রধানমন্ত্রী যে ভাষণ দিলেন তার মধ্যে ন্যূনতম সত্য ছিল না। তিনি যদি এতই উন্নয়ন করে থাকেন তাহলে আরেক নির্বাচন দেন না কেন? বিএনপিকে নিয়ে আমাদের সমালোচনা রয়েছে, সেটা অন্য ব্যাপার। কিন্তু ৫ জানুয়ারি নিয়ে সারাদেশে যা হচ্ছে বা হবে এর জন্য পুরোপুরি দায়ী থাকবে আওয়ামী লীগ।’
মান্না বলেন, ‘বর্তমানে যে সঙ্কট এর থেকে উত্তরণের জন্য আলোচনা কিংবা সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের উচিত সকলের সঙ্গে আলোচনা করে অবিলম্বে আরেকটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।’