রাজধানীতে পরিবহন সঙ্কট, সীমাহীন জনদুর্ভোগ
নির্বাচনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কারণে গণপরিবহনের অভাবে রাজধানীর পথে পথে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
রবিবার দুপুর থেকেই রাজধানীতে গণপরিবহন সংঙ্কট শুরু হয়, তা অব্যাহত ছিল সোমবার দিনভর। যদিও কর্মসূচির মধ্যে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল না। কর্মস্থলে আসতে সোমবার সকালে বাসের সঙ্কটে পড়েন নগরীর মানুষ। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেও একই পরিস্থিতিতে পড়েন তারা। নগরীর রাজপথ ছিল মূলত রিকশা ও সিএনজি অটোরিকশার দখলে। একান্ত নিরুপায় হয়ে এ সব যানে চলাচল করতে যাত্রীদের কয়েকগুণ ভাড়া বেশি গুণতে হয়েছে। অনেকেই বাসের অভাবে ভ্যান, পিকআপ ভ্যানেও যাতায়াত করেছেন।
রাজধানীর টঙ্গী, আবদুল্লাহপুর, উত্তরা, এয়ারপোর্ট, কারওয়ানবাজার, বাবুবাজার, কুড়িল বিশ্বরোড, মিরপুর, গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, শনির আখড়া, রায়েরবাগ, কাঁচপুর এলাকা ঘুরে দ্য রিপোর্টের প্রতিবেদকরা পথে পথে মানুষের দুর্ভোগের চিত্র দেখেছেন।
পর্যাপ্ত যানবাহন না থাকায় রাজধানীর প্রতিটি বাস স্টপেজে কর্মব্যস্ত মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। রাজধানীর টঙ্গী, আবদুল্লাহপুর, উত্তরা ও এয়ারপোর্ট এলাকায় মার্কেট, দোকানপাট, স্কুল-কলেজ খোলা ছিল। তবে সিএনজি স্টেশন ও পেট্রোল পাম্পগুলো ছিল বন্ধ। এ সব এলাকায় সকালের দিকে কোনো বাস চলেনি। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি স্টাফ বাস, আবদুল্লাহপুর-আজিমপুর, আবদুল্লাহপুর-মিরপুর লাইনের কয়েকটি বাস এবং বিক্ষিপ্তভাবে আবদুল্লাহপুর-সায়েদাবাদ লাইনের বাস চলতে দেখা যায়। সকাল ১০টার পর দু-একটি বিআরটিসি বাসও চলতে শুরু করে। তবে এলাকার রাজপথে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, সিএনজি ও অটোরিকশা ছিল প্রচুর। এ ছাড়া পিকআপ ভ্যান কিংবা লরিতেও যাত্রী চলাচল করতে দেখা গেছে।
সকাল ১০টার দিকে এয়ারপোর্ট বাস স্টপেজে কথা হয় গুলশানের এক বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম তালুকদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, আধ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি, কোনো গাড়ি নেই। কোন দেশে এমনটা হতে পারে, এটা বিশ্বাস করা যায় না। আমাদের নিয়ে রাজনীতিবিদরা আর কত খেলবেন।
এদিকে পরিবহন সঙ্কটের কারণে লাগামহীন ভাড়া গুনতে হয়েছে যাত্রীদের। আবদুল্লাহপুর থেকে মহাখালী পর্যন্ত সিএনজি ভাড়া ৫০০ টাকা ও যাত্রী প্রতি ১০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে মিরপুর ও আজিমপুর রুটে দুপুরের দিকে দু’একটি বাস চললেও অন্যান্য দিনের তুলনায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেছে। এ ছাড়া গাজীপুরের দিক থেকে বাস ঢাকায় না আসায় এ সব এলাকার যাত্রীরা ভেঙে ভেঙে টেম্পো, ম্যাক্সি, পিকআপ ভ্যানে করে টঙ্গী পর্যন্ত আসেন।
যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা ও এর আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রচুর যাত্রীর ভিড়, বাসের দেখা নেই। দু’একটি বাসের দেখা মিললেও তাতে জায়গা করে নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন সবাই।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, সানারপাড়, শনির আখড়া ও রায়েরবাগ কাজলা এলাকা থেকে যাত্রীরা বাস না পেয়ে ছোট ছোট পিকআপ ভ্যানে ঝুঁকি নিয়ে যাত্রাবাড়ী আসতে দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রেও যাত্রীদের কয়েকগুণ বেশি ভাড়া গুণতে হয়।
গুলিস্তান সুন্দরবন মার্কেটের একটি দোকানের কর্মচারী মো. শাহীন যাত্রাবাড়ী মোড়ে দাঁড়িয়ে বলেন, শনির আখড়া থেকে যাত্রাবাড়ীতে আসতে বাস ভাড়া পাঁচ টাকা। আর পিকআপে দাঁড়িয়ে ঝুঁকি নিয়ে এসে ভাড়া দিলাম ১০ টাকা।
রাজমিস্ত্রি আবুল হোসেন আমি বাসাবো যামু, কোনো গাড়ি নাই। তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, দেশটা মগের মুল্লুক হইয়া গেছে নাকি। আমরা আওয়ামী লীগ, বিএনপির হাতের তে মুক্তি চাই।
যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষমাণ যাত্রী মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘মতিঝিলে যাওয়ার জন্য কোনো গাড়ি পাচ্ছি না। রিকশা ও সিএনজি ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। যে দু-একটি গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে তাতে তিলধারণের ঠাঁই নেই।’
কোর্টগামী যাত্রী হাফিজুর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আজ অঘোষিত হরতাল চলছে। এ জন্যই গাড়ি নেই। মামলার হাজিরা আছে, তাই যাচ্ছি। তবে কীভাবে যাব তা নিয়ে চিন্তায় আছি।’
বাস না চলায় যাত্রাবাড়ী এলাকায় সিএনজি অটোরিকশা চালকরা যাত্রীদের কাছ থেকে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া আদায় করছে। যাত্রাবাড়ী থেকে মতিঝিলের ভাড়া সর্বোচ্চ ১০ টাকা হলেও সিএনজি অটোরিকশাগুলো প্রত্যেক যাত্রীর কাছ থেকে ভাড়া নিচ্ছে ৪০ টাকা।
মিরপুর-গাবতলী এলাকায় গণপরিবহনের অভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রীদের। সোমবার সকাল থেকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাবু বাজার, কুড়িল বিশ্বরোড, মিরপুর, গাবতলী এলাকা ঘুরেও যাত্রী দুর্ভোগের চিত্র দেখা গেছে। এর মধ্যে দু’একটা গাড়ি চললেও উপচেপড়া ভিড় ঠেলে অধিকাংশ নগরবাসী গাড়িতে উঠতে পারেন নি।
গাড়ি সঙ্কটের কারণে কারওয়ান বাজার এলাকায় দ্য রিপোর্টের প্রতিবেদকের কাছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন গণপরিবহনের জন্য অপেক্ষমাণ ক্ষুব্ধ জনতা। অনেকের ভাষ্য, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি চলাকালীন কর্মজীবী সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করলে ভাল হয়। যাতে করে সাধারণ জনগণের কোনো ভোগান্তি পোহাতে না হয়।’
বঙ্গভবনের পাশে টয়েনবী সার্কুলার রোডে দেখা গেছে অন্য চিত্র। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে দু’একটি বাস গুলিস্তানের দিকে যেতে চাইলেও ওখানে সেগুলো থামিয়ে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে চালকদের মারধর করে সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা।
ভুক্তভোগী দুই গাড়িচালক বলেন, ‘আজ তো কোনো হরতাল নেই, তাহলে আমাদের কেন হয়রানি করা হচ্ছে। আমাদের কী দোষ? আমরা এর বিচার চাই।’
একই অবস্থা চলছে রাজধানীর গাবতলী এলাকায়। সেখানেও চলন্ত ছোট ছোট গাড়ি থেকে কোনো কারণ ছাড়াই যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মারধর করা হচ্ছে গাড়ি চালকদের।
ভুক্তভোগী এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘রাজধানীর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে দেশে জরুরি আইন চলছে। এমন যদি করা হবে তাহলে সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলেই তো আমাদের এমন দুর্ভোগ পোহাতে হতো না।’
বাড়তি টাকা দিয়ে রিকশা ভ্যান ও পিকআপে করে অনেকে তাদের কর্মস্থলে আসলেও আসতে পারেননি কর্মজীবী নারীরা। তীব্র ভিড় ঠেলে কোনো ধরনের যানবাহনে উঠতে না পারায় বাড়ি ফিরে যান তারা।