খালেদার কাছ থেকে নেতাদের বিচ্ছিন্ন করার কৌশল সরকারের
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ জেলা পর্যায়ের অন্তত ৫০ নেতাকে দলীয় রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় করার কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে সরকার। অবরোধ কর্মসূচিকে দুর্বল করতে ও খালেদা জিয়ার কাছ থেকে নেতাদের বিচ্ছিন্ন করতে সরকার এ পরিকল্পনা নিয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, বিএনপি ভাঙনের মুখে পড়ার পর্যায়ে রয়েছে। তবে শীর্ষ নেতাদের আপাতত নিষ্ক্রিয় করে রাখার কৌশলই সরকারের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে বলে জানা গেছে। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কীভাবে নিষ্ক্রিয় করে রাখা যাবে সে সম্পর্কেও একটি ছক তৈরি করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দু’জন নেতা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গত বুধবার রাতে সাক্ষাত করেছেন এমন দু’জন আওয়ামী লীগ নেতা আভাস দিয়েছেন বিএনপির নেতাদের নিয়ে সরকার একটি কৌশল গ্রহণ করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করা ওই দুই নেতার একজন বলেন, বিএনপির চলমান আন্দোলন ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তটুকু নিতেও পিছপা হবেন না বলে আমাদের জানিয়েছেন।
বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখায় ক্ষমতাসীন দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায় এবং সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা বিএনপি নেতাদের আপাতত নিষ্ক্রিয় করে রাখা ও রাজনীতির বাইরে রাখতে করণীয় নির্ধারণে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন বলেও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে থেকে আভাস পাওয়া গেছে।
সরকারি দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, বিএনপি ঘোষিত অবরোধ কর্মসূচি ও সামনের সম্ভাব্য সরকারবিরোধী আন্দোলনকে নিজেদের কব্জায় নিতেই মূলত এ কৌশল। বিএনপির প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারি এবং বিভিন্ন জেলার জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ৫০ জন নেতা এ তালিকায় রয়েছেন। কাউকে আর্থিক প্রলোভন, কাউকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন অথবা পুলিশি হামলা-মামলা এ সবের ভেতর দিয়ে এ কৌশল বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানা গেছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপিকে ভাঙার কোনো কৌশল রয়েছে কিনা, তা জানতে চাইলে দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
বিএনপির চলমান কর্মসূচি মোকাবিলায় সরকারের ভেতরের কৌশল বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ভিন্ন কোনো উপায়ে নয়, রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা হবে বিএনপিকে। তাদের অবরোধ কর্মসূচি ইতোমধ্যেই ব্যর্থ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এ আন্দোলন যত দীর্ঘ হবে তত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে বিএনপি।
তবে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা জানিয়েছেন চলমান বিরোধী আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণে নিতে যা যা করার দরকার সবই করবে সরকার। বিএনপি নেতাদের রাজনীতির বাইরে রাখতে আওয়ামী লীগ ও সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ নিবে।
জানা গেছে, পুলিশি হামলা-ভয়, দুর্নীতির জালে জড়িয়ে মামলা দিয়ে হয়রানি, কারো কারো সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের যোগসাজশ করে নিষ্ক্রিয় করা হবে বলে ছকে রয়েছে। এ ছাড়া বিএনপি অধ্যুষিত কয়েকটি জেলার নেতাকেও নিষ্ক্রিয় করার পরিকল্পনা রয়েছে। অবরোধে যে সব জেলায় সংঘাত-সংঘর্ষ ঘটছে মূলত সে সব জেলাকে এ প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চায় ক্ষমতাসীনরা। এক্ষেত্রে জেলার নেতাদের আর্থিক লোভ দেখিয়ে বা ভিন্ন উপায়ে বশ করা হবে।
এ ছাড়া সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের ব্যবহার করে জেলা নেতাদের নিয়ে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। চট্টগ্রাম বিভাগ ও উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার নেতাদের সঙ্গে ইতোমধ্যে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা আলাপ-আলোচনা শুরুও করেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
আর রাজধানী নিয়ন্ত্রণ করতে ঢাকায় বিএনপির সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই নেতা মির্জা আব্বাস ও হাবিব-উন নবী খান সোহেলকে কব্জায় নিতে ইতোমধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন সরকারের নীতি-নির্ধারণী কয়েকজন নেতা। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও রয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ব্যাপারে সৈয়দ আশরাফ ও মির্জা আব্বাস বিভিন্ন সময়ে টেলিফোনে কথা বলেছেন বলেও জানা গেছে।
সরকারের পক্ষ থেকে যে সকল নেতাদের নিষ্ক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম মির্জা আব্বাস, তরিকুল ইসলাম, এমকে আনোয়ার, হান্নান শাহ, আমান উল্যাহ আমান, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব-উন নবী খান সোহেলসহ আরও বেশ কয়েকজন। সরকারদলীয় দু’জন মন্ত্রী ও সম্পাদকমণ্ডলীর কয়েকজন নেতা জানান, এদের অনেক নেতাই সরকারের কব্জায় রয়েছে। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কর্মসূচি ঘোষণার পরে এদের অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন হতে শুরু করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্র নিশ্চিত করেছে বিএনপির কয়েকজন নেতাকে বিদেশে পাড়ি জমাতেও বলা হয়েছে। জেলা পর্যায়ের বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককেও নিষ্ক্রিয় করার কৌশল রয়েছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিএনপির চলমান কর্মসূচি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় নেতাদের বলেন, আগামী সপ্তাহের মধ্যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। প্রয়োজনে আমি আরও কঠোর এবং বড় ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণেও পিছপা হব না ।
গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার অবস্থান প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাকে তো কেউ অবরুদ্ধ করে রাখে নি। তিনি নিজেই সেখানে আছেন।
গণভবনের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন ৩ জন আওয়ামী লীগ নেতা প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য নিশ্চিত করেছেন।
(সূত্র: দ্য রিপোর্ট)