ইজতেমা শুরু শুক্রবার ; অবরোধ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় বিএনপি
বিশ্ব ইজতেমার সময় অবরোধ কর্মসূচি চলবে কী না তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বিএনপি। রাজধানীর পাশে টঙ্গীর তুরাগ নদীর পাড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুক্রবার এ ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হবে।
ইতোমধ্যেই তুরাগ নদীর পাড়ে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান আসা শুরু করেছেন। কিন্তু রাজপথ, নৌপথ, রেলপথ অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচির কারণে ইজতেমায় অংশগ্রহণে ইচ্ছুক মুসল্লিরা রয়েছেন কিছুটা আশঙ্কায়। যদিও দেশের কোনো স্থানে অবরোধকারীদের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ইজতেমায় অংশ নিতে ইচ্ছুক সাধারণ মুসল্লিদের বাধা দেওয়ার কোনো সংবাদ শোনা যায়নি।
তবে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর বিএনপির হাইকমান্ড থেকে শুরু করে দলটির লাখ লাখ নেতাকর্মী বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিয়ে থাকেন। তাছাড়া রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে দেশের সাধারণ মানুষের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ার ইচ্ছাও দলটির নেই। কিন্তু সরকারের ‘অগণতান্ত্রিক ও অগ্রহণযোগ্য’ কর্মকাণ্ডের কারণে ইজতেমার আগে অবরোধের মতো কঠিন কর্মসূচি দিতে বাধ্য হয়েছে বিএনপি। সরকার সম্পূর্ণ একগুয়েমি ও বেআইনিভাবে বিএনপির জনসভার মতো গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে বাধা দিয়েছে। শুধু জনসভাতে বাধা নয়, দলের চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। তিনি দলের সদর দফতরে যাওয়ার জন্য এবং ঘোষিত কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার জন্য বারবার কার্যালয় থেকে বের হতে চেষ্টা করলেও সরকারের নির্দেশে পুলিশ তাকে বের হতে দেয়নি। এমনকি খালেদা জিয়া ও তার সঙ্গে থাকা দলীয় নেতাকর্মী এবং কর্তব্যরত সংবাদকর্মীদের উপর পুলিশ বিষাক্ত পিপার স্প্রে করেছে। যে কারণে গত পাঁচদিন ধরে দলটির চেয়ারপারসন সেখানে অবরুদ্ধ হয়ে আছেন।
দলের এক সিনিয়র নেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘বিএনপি শুধু বিশ্ব ইজতেমা নয়, সাধারণ মানুষের ভাল-মন্দ সব কিছু বিবেচনায় নিয়েই কর্মসূচি প্রণয়নের চেষ্টা করে থাকে। কারণ বিএনপি জনগণের রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের মতো ধ্বংসাত্মক রাজনীতি বিএনপি করে না। সত্যি কথা বলতে কি, বিএনপি চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগের মতো ধ্বংসাত্মক হতে পারে না। তাই ইজতেমার মতো ধর্মীয় বিষয়টিকে সামনে রেখে বিএনপি চিন্তা-ভাবনা করছে, এ ব্যাপারে কী করা যায়। সে ক্ষেত্রে যে কোনো সিদ্ধান্ত দ্রুত গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে।’
জানা গেছে, কঠিন কর্মসূচি দিতে বাধ্য হলেও ইজতেমার মতো ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় নিয়ে দলের মধ্যে কিছুটা দ্বিধা-বিভক্তি তৈরি হয়েছে। দলের নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ চাচ্ছেন ইজতেমাকে সামনে রেখে আপাতত অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করতে। তাদের যুক্তি হচ্ছে- অবরোধ স্থগিত করার সঙ্গে সঙ্গে ইজতেমার পর পর ঢাকায় আরেকটি সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করা, যা ইজতেমা শেষের একদিন পর হবে। একই সঙ্গে তাদের আরও যুক্তি হচ্ছে— এটা নিশ্চিত যে ইজতেমার পর আবার জনসভার ঘোষণা দিলে দেশে সরকারের পক্ষ থেকে পুনরায় অবরোধ সৃষ্টি করা হবে। সেই ক্ষেত্রে সরকারের এ পদক্ষেপের প্রতিবাদে বিএনপি ফের অবরোধের মতো কঠিন কর্মসূচিতে ফিরে যেতে পারে। এ কারণে বিএনপির প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হবে।
অন্যদিকে, অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার বিষয়েও দলের আরেক পক্ষ তাদের মত প্রকাশ করেছেন। এ পক্ষের যুক্তি হচ্ছে- বিগত সময়ে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি যখন প্রায় সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই এ কর্মসূচি থেকে বিএনপির ফিরে আসার খেসারত এখনো দিয়ে যাচ্ছে। বিগত আন্দোলনের সময় টানা অবরোধে দেশ মূলত স্থবির ও অচল হয়ে পড়েছিল। সরকার কার্যত ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছিল। দেশের সব জেলার সঙ্গে সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আন্দোলনের সেই চরম অবস্থা থেকে বিএনপি সাময়িক বিরতি দিয়ে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকার আবার শক্ত অবস্থায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সুযোগ পেয়েই তারা আবার ভয়ঙ্কর মূর্তি নিয়ে বিএনপির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাই এবার আর কোনো সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না।
সূত্র জানায়, বিএনপির হাইকমান্ড ইজতেমা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-করছেন। এদিকে গত মঙ্গলবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তার গুলশান কার্যালয়ে যান তবলিগ জামায়াতের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে ওই প্রতিনিধি দলের অপর দুই সদস্য হলেন আব্দুল আউয়াল ও মোয়াজ্জেম হোসেন।
সাক্ষাৎ শেষে তারা জানান, বিশ্ব ইজতেমায় দাওয়াত দিতে তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসেছিলেন। তিনি দাওয়াত গ্রহণ করেছেন। একই সঙ্গে বলেছেন, সুস্থ থাকলে এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে তিনি (খালেদা জিয়া) প্রতিবছরের মতো এবারও ইজতেমায় অংশগ্রহণ করবেন।
এদিকে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বৃহস্পতিবার দুপুরে অবরোধ কর্মসূচি চলবে বলে জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নির্দলীয় সরকারের অধীনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত অবরোধ চলবে।’
চলমান অবরোধ কর্মসূচির বিষয়ে দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করে রিজভী আহমেদ বলেন, ‘সারাদেশে সরকারের দমন-পীড়ন অব্যাহত রয়েছে। গতকালও তিনজন নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের নিষ্ঠুর নির্যাতনে সারাদেশে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা আহত হচ্ছে।’
যুগ্ম-মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেন, ‘এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের ওপর দমন-পীড়ন বন্ধ করা না হবে, সমাবেশের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে না দেওয়া হবে ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি স্বচ্ছ নির্বাচনের দাবি মেনে না নেওয়া হবে ততক্ষণ পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।’
এদিকে বিএনপির আরেক যুগ্ম-মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার বিকেলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, অবরুদ্ধ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দুঃশাসনের অবসান ও বিপন্ন গণতন্ত্র পুনঃরুদ্ধারের লক্ষ্যে পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত চলমান সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের সকল নেতাকর্মী ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সালাহউদ্দিন জানান, অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করা হচ্ছে মর্মে বিভিন্ন সরকারি অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।
বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে ধর্মীয় অনুভূতির কথা বিবেচনা করে বিএনপি অবরোধ কর্মসূচি স্থগিতের সম্ভাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির নীতি-নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বিএনপি বিষয়টি বিবেচনা করছে। এ নিয়ে শিগগিরই সিদ্ধান্ত আসতে পারে।’