রাজনৈতিক সহিংসতায় ৩৮ বাসে আগুন আতঙ্কের নগরী রাতের ঢাকা
বিএনপির ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধে রাজধানীতে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে প্রতিদিন। আর অধিকাংশ ঘটনা শুরু হয় বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত। এতে সন্ধ্যার পরপর রাজধানীতে গণপরিবহনের সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যাচ্ছে। আর যাও চলছে তাতে চড়তে ভয় ও আতঙ্ক কাজ করছে সাধারণ মানুষের মনে। রাতের ঢাকা নগরবাসীর কাছে আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জনমনে কোনো আতঙ্ক নেই। সবাই স্বাভাবিকভাবেই চলচলা করছে। সরকার কঠোর হস্তে নাশকতা ও সহিংসতা দমন করছে।
গত ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পাল্টা-পাল্টি সমাবেশকে কেন্দ্র করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সকল প্রকার সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। অন্যদিকে যে কোনো মূল্যে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয় বিএনপি ও যথাসময়ে বিএনপির প্রধান কার্যালয় নয়াপল্টনে দলের চেয়ারপারসন উপস্থিত হবেন বলেও ঘোষণা দেয়। আর সমাবেশে উপস্থিত হওয়ার জন্য আগে থেকেই নিজের গুলশান কার্যালয়ে উপস্থিত হন বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু সরকার বিএনপি চেয়ারপারসনের নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে তার গুলশান কার্যালয়ের রাস্তায় বালু, ইটভর্তি মোট ১৩টি ট্রাক, জলকামান, পুলিশ বহনকারী ট্রাক ও এপিসি দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে রাখে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ৫ জানুয়ারি গুলশান কার্যালয় থেকে বের হতে চাইলে বেগম জিয়াকে আটকে দেয় পুলিশ। এ সময় কার্যালয়ের ভেতরে থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন ও তার নেতাকর্মীদের ওপর পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করে পুলিশ। পরে অবরুদ্ধ অবস্থায় খালেদা জিয়া সমাবেশ করতে বাঁধা দেওয়ায় অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
তবে গাড়িতে আগুন দেওয়া শুরু হয় ৪ জানুয়ারি রবিবার থেকে। সকল রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ডিএমপি নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় রবিবার থেকে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে। তথ্যানুযায়ী ৪ জানুয়ারি রবিবার থেকে ৯ জানুয়ারি শুক্রবার পর্যন্ত রাজধানীতে মোট ৩৮টি যানবহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন।
৪ জানুয়ারি তেজগাঁও মহিলা কলেজের সামনে দুপুর সোয়া ২টার দিকে একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে নিউ ভিশন পরিবহনের একটি বাসে দুপুর পৌনে ২টার দিকে আগুন দেওয়া হয়। সন্ধ্যা সোয়া ৭টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে আজিমপুরে বিকল্প সিটি ও উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়া জুরাইন ও পোস্তাগোলায় দুটি পিকআপভ্যানে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। সবুজবাগের পূর্ব কদমতলী এলাকায় মিরপুরগামী একটি বাসে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আগুন দেয় দুর্বুত্তরা। গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারের সামনে তানজিল পরিবহনের একটি বাসে সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে আগুন দেওয়া হয়। পুরান ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় সন্ধ্যায় বাহাদুর শাহ পরিবহনের একটি মিনিবাসে এবং শনির আখড়ায় একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। যমুনা ফিউচার পার্কে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে দুটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এর একটি বাসের নাম সুপ্রভাত।
অবরোধ ঘোষণার আগের দিন ৫ জানুয়ারি সোমবার পল্টনে পুলিশের এক সার্জেন্টের মোটরসাইকেলে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। বিজয়নগর কালভার্ট রোড এলাকায় সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় এ ঘটনা ঘটে এবং ভোরে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকায় সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়।
অবরোধের প্রথম দিন ৬ জানুয়ারি মঙ্গলবার আটটি গাড়িতে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় মনোয়ার হোসেন (৪০) নামে এক আনসার সদস্য ও আমজাদ হোসেনে নামে এক পিকআপভ্যান চালক দগ্ধ হন।
রাজউকের (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) সামনে দুপুর ২টার দিকে একটি বিআরটিসি বাস ও একটি প্রাইভেটকারে, বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে শাহবাগে শিকড় পরিবহনের একটি বাসে, একই সময়ে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার মোড়ে একটি যাত্রীবাহী বাসে, বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ের সামনে একটি ৬ নাম্বার বাসে (ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-১৫৪৬), কদমতলীর লাল মসজিদের সামনে সকাল ৬টার দিকে পুলিশের একটি লেগুনায়, সন্ধ্যায় লালবাগ পোস্তা পুলিশ ফাঁড়ির পাশে একটি পিকআপভ্যানে, রাত ৮টার দিকে বাড্ডায় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় (ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-০৫৭৫) আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
অবরোধের দ্বিতীয় দিন ৭ জানুয়ারি বুধবার রাজধানীতে চারটি গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, রাত পৌনে ৮টার দিকে মিরপুর ১০ নাম্বারে একটি গাড়িতে, সন্ধ্যা ৭টার দিকে আজিমপুরে একটি বাসে, পৌনে ৭টার দিকে ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে তানজিল পরিবহনের একটি বাস ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় ৬টা ২০ মিনিটে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বহন করা একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।
ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বরত কর্মকর্তা ফরিদুজ্জামান জানান, খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মিরপুর ১০, আজিমপুর, ভিক্টোরিয়া পার্ক ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় উপস্থিত হয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
অবরোধের তৃতীয় দিন ৮ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাজধানীতে ১১টি গাড়িতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। মতিঝিল থানা গলিতে দুপুর পৌনে দুইটার দিকে একটি বাসে আগুন ও শাপলা চত্বর এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাসে, নীলক্ষেতে দুপুর আড়াইটার দিকে নিউ সুপার ভিশন নামে একটি বাসে, বনশ্রীতে রবরব পরিবহনের একটি বাসে, সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে দিশারী পরিবহনের একটি বাসে, সন্ধ্যা ৭টার দিকে কমলাপুরের টিটিপাড়ার আইটি ভবনের সামনে একটি গাড়িতে, সোয়া ৭টায় মহাখালীতে একটি যাত্রীবাহী বাসে, রাত সোয়া ৮টার দিকে মিরপুর-১০ নম্বর ও আরামবাগে দুইটি যাত্রীবাহী বাসে, শান্তিনগরে রাত সোয়া ৯টার দিকে তরঙ্গ পরিবহনে এবং রাত ১০টার দিকে কল্যাণপুরে একটি বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
প্রতিটি ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের দুটি গাড়ির চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে বলে জানান ডিউটি অফিসার নিলুফার ইয়াসমিন।
অবরোধের চতুর্থ দিন ৯ জানুয়ারি শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে রাজধানীর মহাখালির নাবিস্কোর সামনে বলাকা পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো- জ-১১-১৭০৭) একটি বাসে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। খবর পেয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় ফায়ার সার্ভিস আগুন নির্বাপণ করে।
অবরোধে এ সব নাশকতা তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, অধিকাংশ যানবহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটছে সন্ধ্যা থেকে রাতের মধ্যে।
এ ব্যাপারে ফতেহ ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেডের ম্যানেজার আলমগীর হোসেন বলেন, ‘অবরোধে আমাদের কোম্পানির অর্ধেক বাস রাজধানীতে চলাচল করছে। তবে রাতে বাসের সংখ্যা আস্তে আস্তে কমিয়ে ফেলা হয়। কারণ যেভাবে আগুনের ঘটনা ঘটছে এতে রাস্তায় গাড়ি রাখতে সাহস পাচ্ছি না। সন্ধ্যা ছয়টার পর থেকে বাসের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আগে যে বাসটা মতিঝিল-আরামবাগ থেকে মোহাম্মদপুরে এসে সন্ধ্যা ৬টায় পৌঁছেছে সেটা আবার নতুন ট্রিপ নিয়ে মতিঝিল গেছে। এভাবে রাত ৮টা পর্যন্ত আমাদের বাস প্রতিনিয়ত ট্রিপ দিয়েছে। কিন্তু এখন আমরা ৬টার দিকে যে বাস লাস্ট স্টপেজে আসছে (শেষ স্ট্যান্ড) সেখানেই ওটাকে বন্ধ করে দিচ্ছি। এতে রাত ১০টার মধ্যে আমাদের বাস রাজধানীতে চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। আগে যেখানে ১২টা থেকে ১টা পর্যন্তও গাড়ি চলেছে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সরকার ও বিএনপির পারস্পারিক দ্বন্দ্বে নাশকতার শিকার হচ্ছে সাধারণ জনগণ। একদিকে সরকার বিরোধী দলকে দমন করতে যা ইচ্ছা তাই করছে। বিএনপির চেয়ারপারসনকে একপ্রকার অবরুদ্ধ করেই রেখেছে সরকার। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে বিএনপি যে ধরনের কর্মসূচি পালন করছে তাতে জনগণের ক্ষতিটাই বেশি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘অবরোধে কোনো দলের নেতাকর্মী মাঠে আছে সেটা বড় কথা না। দুই একটি ঘটনায় জনমনে বিশেষ করে রাজধানীবাসীর মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। কেউ তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি বের করছে না। সাধারণ মানুষ যে গণ-পরিবহনে চড়বে সেটারও নিরাপত্তা নেই। প্রতিদিনই বাসে আগুনের ঘটনা ঘটছে। আমি এখন ঘর থেকে বের হলে বাসে চড়বো নাকি রিকশায় চড়বো চিন্তায় পড়ে যায়। কারণ বাসে উঠলে যে তাতে আগুন দিবে না- এই নিশ্চয়তা কোথায়।’
বদিউল আলম বলেন, ‘সরকার হয়তো বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করতে পারছে। কিন্তু নাশকতা কতটা দমন করতে পারছে সেটা দেখা যায় বাসে আগুনের চিত্র দেখলে।’
তবে রাজধানীবাসীর মধ্যে কোনো আতঙ্ক নেই উল্লেখ করে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘রাজধানীতে বাসে আগুনের ঘটনায় জনমনে কোনো ভয় বা আতঙ্ক নেই। ভয় বা আতঙ্ক রয়েছে বিএনপি, জামায়াত-শিবির, রাজাকারদের মনে। মানুষ যখন রাতে একা চলাচল করতে ভয় পায় তখন সে গলা ফাটিয়ে গান গাইতে থাকে। এতে সে একটু ভয় কমাতে চায়। বিএনপিও ঠিক নিজেদের ভয় ও আতঙ্ক কমাতে রাতের বেলায় ককটেল ফাটাচ্ছে, বাসে আগুন দিচ্ছে। এগুলো জনগণের মনে কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারেনি।’
শাজাহান খান বলেন, ‘জনগণ বিএনপির এমন কর্মসূচিতে যে আতঙ্কিত নয় তার প্রমাণ হলো ঢাকার কর্মচঞ্চল ব্যস্ততা। সবাই সবার মতো কাজে যাচ্ছে, ঘরে ফিরছে।’
রাজধানীর একই স্পটে প্রতিনিয়ত বাসে আগুনের ঘটনায় প্রশাসনের কাছে গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতি আছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নাশকতাকারীরা যা করে হঠাৎ করেই করে। এরা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছু করে না। আকস্মিক নাশকতা ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। তবে পুলিশ এ সব ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন রয়েছে। নাশকতাকারীদের দমনে পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার চেষ্টায় কোনো ঘাটতি নেই। অচিরেই সব কিছু নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’