শেখ হাসিনা আবে হবেন, না রাজাপক্ষে? সোহরাব হাসান
গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সামনে গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। বছরের শুরুতে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও এই বিদ্যালয়টি বন্ধ আছে অবরোধের কারণে। ৫ জানুয়ারির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সরকার পাঁচ দিন ধরে অবরোধ করে রেখেছে সড়কটি। কোনো যানবাহন, এমনকি পথচারীদেরও ঢুকতে দিচ্ছে না পুলিশ। গুলশান মডেল স্কুল ও কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সেখানে ঢুকতে চাইলে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এই হলো দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতির নমুনা।
সরকার দেশের শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে সম্ভবত সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি ঠাহর করছে। না হলে গৃহবন্দী করে রাখবে কেন? তবে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী দাবি করছেন, খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়নি। তাঁর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সরকার তাঁর নিরাপত্তা এমনটাই জোরদার করেছে যে গেট দিয়ে পেপার স্প্রে ছাড়া কিছুই ঢুকতে পারছে না। প্রধান ফটকে পুলিশের কয়েক শ সদস্য মোতায়েন করেই সরকার ক্ষান্ত হয়নি, গেটে মস্ত তালাও লাগিয়ে দিয়েছে। তালা দেওয়া হয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও। আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপির অফিসে তালা ঝুলবে, বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের অফিসে। এটাই নব্বই-পরবর্তী গণতন্ত্রের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে পড়েছে। আর প্রেতের অট্টহাসিতে আকাশ কাঁপাচ্ছে স্বৈরাচার।
সরকার বিএনপির নেত্রীকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। আর বিএনপির আত্মগোপনকারী নেতারা হঠাৎ প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে বলছেন, যত দিন খালেদা জিয়ার অবরোধ তুলে না নেওয়া হবে, তত দিন সারা দেশে অবরোধ চলবে। ৫ জানুয়ারি খালেদা জিয়া অবরোধ ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন স্থানে বাস পোড়ানো, গাড়ি পোড়ানো, রেললাইনের ফিশপ্লেট তুলে ফেলার তাণ্ডব শুরু হয়ে যায়। গণতন্ত্র রক্ষার নামে সরকার বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে আর বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা তার প্রতিবাদে বাসে-ট্রেনে আগুন দিচ্ছেন, ভাঙচুর করছেন। রাজায় রাজায় যুদ্ধ চলে আর প্রাণ যায় নলখাগড়ারূপী সাধারণ মানুষের।
এই মুহূর্তে সবকিছু স্বাভাবিক আছে বলে সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরা যতই আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলুন না কেন, প্রকৃতপক্ষে কিছুই ঠিকমতো চলছে না। মানুষ খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে আসে না। সরকারের মন্ত্রী-নেতাদের বাগাড়ম্বরে তারা আশ্বস্ত হতে পারছে না। সরকার যে সত্যটি স্বীকার করছে না, তা হলো পুলিশ-র্যাব-বিজিবি দিয়ে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা যায় না।
সরকারি দলের নেতারা দিনরাত বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন যে বিরোধী দলের অবরোধের আহ্বানে নাকি কেউ সাড়া দেয়নি। যদি সাড়াই না দেবে, তাহলে একটি সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকার সারা দেশের মানুষকে মহা-অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে কেন? সরকারের দায়িত্ব জনজীবন স্বাভাবিক রাখা। অর্থনীতির চাকা সচল রাখা। নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু সেটা তারা দিতে পারছে না। যে সরকার পুলিশ, র্যাব, বিজিবির কঠোর প্রহরায়ও বিরোধী দলকে একটি জনসভা করতে দিতে ভয় পায়, সেই সরকার মানুষের নিরাপত্তা কীভাবে দেবে?
খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে সরকার বিচলিত। আর দেশবাসী বিচলিত দেশের হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে। বিচলিত পণ্য পরিবহন নিয়ে। অবরোধের কারণে দেশটাই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। ৫ জানুয়ারি সামনে রেখে প্রথমে সরকার সারা দেশে বাস-ট্রেন-লঞ্চ চলাচল বন্ধ রেখে অবরোধ পালন করতে দেশবাসীকে বাধ্য করল। এখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট বাসে আগুন দিয়ে, ভাঙচুর করে, বোমা ফাটিয়ে, আগুনে পুড়ে মানুষ মেরে, পুলিশের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। তাদের রোষানল থেকে রেহাই পায়নি স্কুলের শিশু, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোর, হাসপাতালগামী রোগী ও পণ্যবাহী ট্রাক।
বাংলাদেশে এর আগে এ ধরনের কর্মসূচিতে সব সরকারের আমলেই কমবেশি সহিংসতা হয়েছে। জনজীবন স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে দুই পক্ষই কাছা দিয়ে মাঠে নেমেছে। একদিকে ছাত্রশিবিরকে নিয়ে মাঠে নেমেছে ছাত্রদল ও যুবদল; অন্যদিকে পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা মাঠ দখল করে আছেন। প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালাচ্ছেন। দুই পক্ষ কখনো মুখোমুখি, কখনো গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করে যাচ্ছে। তাদের এই আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া যদি তাদের মধ্যে সীমিত থাকত, তাহলে মানুষকে এতটা বিচলিত হতে হতো না।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পর লিখেছিলাম, আগের অবস্থায় ফিরবে না বাংলাদেশ। মোটামুটি একটি বছর স্থিতিশীল ছিল। বিরোধী দলও কোনো মারমুখী কর্মসূচি দেয়নি। জ্বালাও-পোড়াও করেনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সরকার ও বিরোধী দল মিলে ২০১৩ সালের পুনরাবৃত্তিই ঘটাতে চাইছে। এর শেষ কোথায়?
খেলার নিয়ম মানছেন না কেউ
প্রতিটি খেলারই একটা নিয়ম আছে। বিধিমালা আছে। সেই নিয়ম ভাঙলে সংশ্লিষ্টকে শাস্তি পেতে হয়। বাংলাদেশের সেরা খেলোয়াড় আশরাফুল ক্রিকেটের সেই নিয়মটা ভেঙেছেন বলে এখন শাস্তি পাচ্ছেন। এমনকি টেলিভিশনে আমরা যে মারদাঙ্গা রেসলিং দেখি, সেটাও নিয়মের বাইরে যেতে পারে না। কোনো খেলোয়াড় নিয়ম ভাঙলে আম্পায়ার নম্বর কেটে দেন। তাঁকে চূড়ান্তভাবে খেলা থেকে বাদ দেওয়ার উদাহরণও আছে। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনীতির খেলার যে আম্পায়ার জনগণ, রাজনীতিকেরা মোটেই তাদের আবেগ–অনুভূতি, চাওয়া–পাওয়াকে আমলে নেন না। তাঁরা নিয়মের ধার ধারেন না। ক্ষমতার স্বার্থে তাঁরা একটা নিয়ম গড়েন, আবার ক্ষমতার স্বার্থেই সেটি ভাঙেন (তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আচরণ লক্ষ করুন)।
এটা সর্বজনবিদিত যে খেলোয়াড়ের অবস্থানের ওপর খেলার নিয়ম নির্ভর করে না। তিনি যে অবস্থানেই থাকুন না কেন, তাঁকে আইন মানতে হয়। কিন্তু আমাদের রাজনীতিকেরা ক্ষমতায় থাকতে যাকে অবশ্যকরণীয় বলে মানেন, বিরোধী দলে থাকতে সেটিকেই বেনিয়ম, বেআইনি বলে চালিয়ে দিতে চান। আবার বিরোধী দলে থাকতে যাকে তারা শক্তির উৎস মনে করেন, সরকারে গেলে সেটিকে পরিত্যাজ্য ঘোষণা করেন। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তাও হয়তো মেনে নিলাম। কিন্তু সরকার যখন নিজ দলের কর্মীদের মাঠে নামিয়ে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ বন্ধ করে দেয়, তখন আর আইনের শাসন আছে বলা যায় না। আবার বিরোধী দলের কর্মীরা যখন গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে, রেললাইনের ফিশপ্লেট সরিয়ে অবরোধ পালন করেন, তখন সেটিও আর আন্দোলন থাকে না। হয়ে পড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।
শেখ হাসিনা আবে হবেন, না রাজাপক্ষে?
সম্প্রতি এশিয়ার দুটি দেশে দুটি তাৎপর্যপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। দুটোই আগাম নির্বাচন। কিন্তু ফলাফল ভিন্ন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে প্রথম ক্ষমতায় আসেন ২০১২ সালে। সেই হিসাবে ২০১৬ সালে নির্বাচন হওয়ার কথা। নির্বাচিত হয়ে তিনি যে অর্থনৈতিক সংস্কার করেছেন, তা নিয়ে বিরোধীদের প্রবল আপত্তি ছিল, এখনো আছে। কিন্তু বিরোধীদের আপত্তি উপেক্ষা করে তিনি সরকারি ব্যয় কয়েক গুণ বাড়িয়েছেন। আর সেই ব্যয় বাড়াতে গিয়ে জনগণের ওপর ট্যাক্সের বোঝাও বেড়েছে। আগের সরকার ঋণ নিয়ে সরকারি ব্যয় মেটাত। আবের মতে, এটি ভুল পথ। তাঁর সংস্কার কর্মসূচির মাত্র অর্ধেক বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি অর্ধেক বাস্তবায়নের জন্য তিনি গত ডিসেম্বরে আগাম নির্বাচন দিয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি আসনে জয়ী হয়েছেন। দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এখন আর কর্মসূচি বাস্তবায়নে কোনো বাধা নেই তাঁর।
অপর দেশটি শ্রীলঙ্কা। সেখানে এক দশক ধরে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত আছেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। কঠোর মনোভাবের এই নেতা ২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহ দমন করেন, যাতে এলটিটিইর নেতা প্রভাকরণ নিহত হন। সিংহলিরা এটিকে তাদের জাতিগত বিজয় বলে মনে করে। সাম্প্রতিক কালে অর্থনৈতিক মন্দা ও পণ্যমূল্য বেড়ে গেলেও রাজাপক্ষে আমলে নেননি। তিনি প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ২০০৫ সালে। ২০১০ সালে দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তাঁর কর্তৃত্ববাদী শাসনের শিকার হয়েছে বিরোধী দল, গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষ। তামিল বিদ্রোহ দমনে বাড়াবাড়ির জন্য তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধেরও অভিযোগ আছে। তিনি আগাম নির্বাচন দিয়ে বিদ্রোহ দমনের সুফল ভোটের বাক্সে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে, শেখ হাসিনা কী করবেন? বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অবরোধ চলছে, তা চিরকাল চলতে পারে না। আশা করি, জনগণের কথা ভেবে দুই পক্ষই অবিলম্বে অবরোধ তুলে নেবে। কিন্তু তাতে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। সেই সমাধানের জন্য একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হবে; সেটি সরকারের দাবি অনুযায়ী ২০১৯ সালে কিংবা বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী ‘অবিলম্বে’, যখনই হোক। এর ফলাফল কী হবে? দুই উদাহরণই শেখ হাসিনার সামনে আছে। জাপান ও শ্রীলঙ্কা। এর আগে ঘরের উদাহরণও দেওয়া যায়। ২০০১ সালে শেখ হাসিনা আগাম নির্বাচন দেওয়ার কথা বলে সরে এসেছিলেন। ২০০৭ সালে খালেদা জিয়া নির্বাচনটিই করতে দিলেন না। তার ফলও তাঁরা হাতেনাতে পেয়েছেন। এবার তত্ত্বাবধায়ক নেই, বিরোধী দল সংসদেও নেই। সব কার্ডই এখন শেখ হাসিনার হাতে। তিনি কীভাবে খেলেন, তার ওপরই নির্ভর করবে রাজনীতি ও নির্বাচনের ফলাফল।
জাপানে আবে বিরোধীদের সমালোচনার জবাবে নিজের জনপ্রিয়তা যাচাই করতে আগাম নির্বাচন দিয়ে জয়ী হয়েছেন। রাজাপক্ষে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন এবং গণমাধ্যমকে একহাত নিয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কার ভোটাররা এবার তাঁর স্থলে এককালে তাঁরই স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাইথ্রিপালা সিরিসেনাকে বেছে নিয়েছে।
যখনই নির্বাচন হোক না কেন, শেখ হাসিনা আবে হবেন, না রাজাপক্ষে—সেটাই দেখার বিষয়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net