মামলায় শৃঙ্খলিত বিএনপির আন্দোলন
মামলায় শৃঙ্খলিত হয়ে পড়েছে বিএনপির আন্দোলন। কেন্দ্রীয় নেতাসহ জেলা উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের নামে একাধিক মামলা থাকায় অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী, যার নেতিবাচক প্রভাবে অবরোধের কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তুলতে পারছে না দলটি।
বিএনপির অনেক নেতা এখন জেলবন্দী। আবার যারা জামিনে মুক্ত আছেন তারাও নিয়মিত আদালতে হাজিরায় ব্যস্ত থাকছেন। এ কারণে আন্দোলনে যুক্ত হতে পারছেন না। মামলার কারণে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় অনেক সিনিয়র নেতা দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। মামলাকে সামনে রেখে সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপিকে ভাঙারও চেষ্ঠা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং বৃহস্পতিবার রাতে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বলেন, ‘মামলাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সরকার ষড়যন্ত্রের জাল পেতেছে। মামলার ভয় দেখিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের দলীয় কর্মকাণ্ড ও আন্দোলন থেকে নিষ্ক্রিয় রাখার চেষ্টা করছে। মামলার জালে ফেলে কাউকে কাউকে সরকারবিরোধী বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা ও একই মামলার রায়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখিয়ে দলের ভেতরে সন্দেহ-অবিশ্বাস সৃষ্টিরও চেষ্টা করছে সরকার। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মধ্যেও কোনো কোনো নেতাকে নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। দলের মধ্যে কেউ সরকারের এজেন্ট, কেউ বিশেষ সংস্থার লোক বলেও প্রচারণা বাড়ছে।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে ৬ জানুয়ারি প্রেস ক্লাব থেকে গ্রেফতারের আগে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সরকার আন্দোলন দমানোর কৌশল হিসেবে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। এ সব মামলার কারণে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। দলীয় কর্মকাণ্ড ফেলে নেতাকর্মীদের নিয়মিত আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে। মামলা মোকাবেলায় ব্যস্ততার কারণে কোনো সাংগঠনিক কাজও করা যাচ্ছে না।’
বিএনপির মুখপাত্র বলেন, ‘এ দেশে দুই রকমের আইন চলছে। একটি অবৈধভাবে ক্ষমতায় চেপে বসা আওয়ামী লীগের জন্য। তারা সাত খুন করে মাফ পাচ্ছে। কোনো বিচার হচ্ছে না। অন্যদিকে বিএনপিসহ দেশের অন্য বিরোধী দল ও সাধারণ নাগরিকদের জন্য আলাদা আইন কার্যকর হচ্ছে। তারা মিথ্যা মামলায় হয়রানি, নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।’
ফখরুল বলেন, ‘প্রতিদিন আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। সারাদেশে এমন কোনো বিএনপি নেতাকর্মী নেই যার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। সারাদেশে কমপক্ষে সাড়ে ১৪ হাজার মিথ্যা মামলা দিয়ে সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষকে আসামি করে সরকার হয়রানি করছে।’
এদিকে মামলার সংখ্যা এত যে, অনেক নেতাই তার বিরুদ্ধে কতটি মামলা রয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন না। সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি ঢাকার আদালতে দলের নেতাদের মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী এ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া।
তার তথ্য আনুযায়ী, শীর্ষ থেকে শুরু করে সারাদেশে মামলার সংখ্যা হবে প্রায় ৩০ হাজার। এর মধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকা শহরেই গত দুই বছরে সাড়ে চার হাজারের বেশি নতুন মামলা হয়েছে। আর এ সব মামলার আসামী দুই থেকে তিন লাখের মতো নেতাকর্মী।
জানা গেছে, বিএনপির সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার গড় ১৫টিরও বেশি। এর মধ্যে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে রয়েছে ৬৮টি মামলা। যার মধ্যে চার্জ গঠন হয়েছে ২৫টিতে। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ১৬, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ১৪, এম কে আনোয়ার ৯, হান্নান শাহ ৮, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ২৭, মির্জা আব্বাস ৭৪ ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধেও রয়েছে ১০-১২টি করে মামলা। ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে এম মোর্শেদ খান, আব্দুল্লাহ আল নোমান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, শমসের মবিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের সময়ে গড়ে ৮-১০টি করে মামলা হয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১৪টি। একাধিক রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাসহ তার কয়েক মামলার চার্জশিটও দাখিল হয়েছে। একই সঙ্গে সাত যুগ্ম-মহাসচিবের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের আমলে দায়ের করা হয়েছে অসংখ্য মামলা। এ ছাড়া প্রতিটি অঙ্গ দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য মামলা।
অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে যুবদলের সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১২৪টি, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে ৩৫টি, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরবের বিরুদ্ধে ৫৩, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু ও সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল বারী বাবুর নামে রয়েছে ২৬টি করে মামলা। আর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির নির্বাহী কমিটির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর বিরুদ্ধে মামলা ৫৩টি এবং ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর নামে ১১৯টি মামলা রয়েছে। ছাত্রদলের সদ্য সাবেক সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলের নামে ৪৭টি ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিবের নামে ৬৫টি মামলা রয়েছে। ছাত্রদলের নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান-আকরামুল হাসানের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৩-৪টি করে।
এদিকে মামলাকে কেন্দ্র করে বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতার হঠাৎ নীরব হয়ে যাওয়ার বিষয় নিয়ে দলের ভেতরে গুঞ্জন ও আলোচনা হচ্ছে। কেন তারা সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে দূরে থাকছেন; তা নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে চলছে গুঞ্জন। কেউ বলছেন, সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাত। অনেকের ধারণা, কারাভোগের নিঃসঙ্গতা ও কষ্ট এড়াতেই কৌশল নিয়েছেন তারা।
দুদকের একটি মামলায় কারাগারে আছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তার গ্রেফতারের বিষয়টিও ওই চক্রান্তের অংশ বলে দাবি করেছেন বিএনপি নেতারা। তাদের ধারণা, কারাগার থেকে বের হতে হলে তাকে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে হবে। নইলে কারাগারেই থাকতে হবে। এমনকি কারাদণ্ডও হতে পারে।
বিএনপির সব কর্মসূচিতে বেশ সক্রিয় থাকতেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের কর্মসূচিতে প্রায়ই তাকে অতিথি, প্রধান অতিথি হিসেবে দেখা যেত। জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিএনপি সমর্থক বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের কর্মসূচিতে তিনি থাকতেন নিয়মিত। ‘মিডিয়া কাভারেজ’ পেতে মওদুদ খুবই পছন্দ করেন, তার সম্পর্কে এমন ধারণাও প্রচলিত আছে। সেই মওদুদ আহমদ এখন একেবারেই নিশ্চুপ, আড়ালে। কেন এ অবস্থা? এমন প্রশ্নের উত্তর মওদুদের কাছে পাওয়া যায়নি। মিডিয়াকে একেবারেই এড়িয়ে চলছেন তিনি। তার মোবাইল নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। তার চেম্বারে ফোন করা হলে সেখান থেকে জানানো হয়, স্যার এখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন না।
জানা গেছে, সরকারবিরোধী বক্তব্য দিলে মওদুদ আহমদের গুলশানের বাড়িটি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই তিনি একেবারেই চুপসে গেছেন। গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি দুদকের দায়ের করা মামলায় বেশ কিছুদিন কারাগারে থাকার পর মুক্তি পান মওদুদ। এরপর মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকও করেন তিনি।
একই দিনে গ্রেফতার হওয়া স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য এম কে আনোয়ারও চুপচাপ হয়ে পড়েছেন। গ্রেফতার হওয়ার আগে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক সরব ছিলেন দলটির প্রবীণ এই নেতা। দলের কর্মসূচিতে নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন। ব্যাপক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সরকারের দুর্নীতি, লুটপাটের চিত্র তুলে ধরতেন। মুক্তি পাওয়ার পর এখন পর্যন্ত হাতেগোনা কিছু কর্মসূচি ছাড়া নিয়মিত দেখা যায়নি তাকে।
একই অবস্থা বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সিনিয়র আইনজীবী এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের ক্ষেত্রে। সরকারবিরোধী বক্তব্য দিয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে গ্রেফতার হওয়ার পর দীর্ঘ সময় নিশ্চুপ ছিলেন। তবে সম্প্রতি এই নেতা আবার সরব হয়েছেন।
বিএনপির নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত যুগ্ম-মহাসচিব আমানউল্লাহ আমানও অনেকটা নিষ্ক্রিয়। এর মধ্যে একাধিকবার কারাগারে গিয়ে আবার মুক্তি পেলেও কখন তিনি বের হলেন, কখন জেলে গেলেন, তা টেরই পাওয়া যায়নি। বিএনপিতে জনশ্রুতি আছে ‘আমান হচ্ছেন খালেদা জিয়ার আন্দোলনের কামান।’ ’৯০-এর দশকে দেশে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সফল নেতৃত্ব আমানের আন্দোলনে নিষ্ক্রিয়তা দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক গুঞ্জনের সৃষ্টি করেছে।
জানা গেছে, মামলাকে সামনে রেখে বিএনপি ভাঙারও ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। দলের একটি অংশকে দিয়ে পৃথক বিএনপি গঠনের চেষ্টা চলছে। এর আগেও সরকারের রোষানলে পড়ে বিএনপিতে ভাঙনের সুর বেজে উঠলেও তা থেমে যায়। কখনও সরকারের চাপে, কখনও বা দলের ওপর ক্ষোভ থেকে পৃথক দল করেছেন কয়েকজন নেতা। ভাঙা-গড়ার এই খেলায় বারবারই বিএনপি বিপর্যস্ত হয়েছে। সর্বশেষ ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেনের পর বড় ধরনের ভাঙনের মুখে পড়ে দলটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ছয় দফা ভাঙনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে আতঙ্কে আছে বিএনপি।
বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বিষয়ে দলের ঢাকা মহানগর কমিটির সদস্য সচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল বলেন, ‘মামলার কারণে স্বাভাবিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনই আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার ষড়যন্ত্র করে একের পর এক মামলা দিচ্ছে। বিগত সময়ে বিএনপির বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। এখনও হয়ত দলের ও দেশের ভেতরে-বাইরে বিএনপিকে ধ্বংসের চেষ্টা হচ্ছে। নেতাকর্মীদের এ সব প্রতিরোধ করে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে।’
মামলার বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, ‘জনগণের সঙ্গে ব্ল্যাকমেইলিং ও গণতন্ত্র ধ্বংস করতে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সব মিথ্যা-বানোয়াট মামলা দেওয়া হচ্ছে। দেশব্যাপী মিথ্যা মামলার সুনামি চলছে।’
তিনি বলেন, ‘মামলা-নিপীড়ন, নির্যাতন করে কখনও অতীতে আন্দোলন দুর্বল করা যায়নি। এই ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার এবারও পারবে না, যারা এ সব করছে তারা পপাত ধরণীতল হয়ে যাবে।’