অবরোধে নির্মমতার শিকার সাধারণ মানুষ
অমূল্য চন্দ্র বর্মণ পেশায় রিকশাচালক। পাঁচ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। জমানো টাকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ে যাওয়ার উদ্দেশে শনিবার সকালে ঘর থেকে বের হন। বাসে করে তেজগাঁওয়ে পৌঁছলে ওই বাসেই পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। সেই আগুনেই সারা শরীর পুড়ে স্থান হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে।
শুধু অমূল্যই নয়, চলমান অবরোধে এমন অনেক বাসচালক, হেলপারদের মতো নিরীহ মানুষেরা অবরোধে পিকেটারদের ইটপাটকেল, পেট্রোলবোমা ও ককটেলের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছেন। শুধু ক্ষত-বিক্ষতই নয়, অনেকেই আবার পরিবার-পরিজন ছেড়ে পরপারের পথ ধরছেন। এক কথায় বলতে গেলে, রাজনীতির রোষানলে নির্মমতার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
অমূল্য জানান, তিনি তিন সন্তানের জনক। বড় ছেলে নিতাই চন্দ্র বর্মণ এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। ছোট দুই ছেলের মধ্যে রতন চন্দ্র বর্মণ ৫ম শ্রেণীতে এবং জয় চন্দ্র বর্মণের বয়স তিন বছর।
তিনি বলেন, ‘আমি রাজনীতি বুঝি না। দিন আনি দিন খাই। রিকশা চালানোর টাকা দিয়ে সংসার চলে। কাজে না করলে পরিবারকে অনাহারে থাকতে হয়। জানি না এখন পরিবারের কি হবে?’
ঢামেকের বার্ন ইউনিটে সোমবার সন্ধ্যায় বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, অমূল্যসহ অনেকেই অবরোধে অগ্নিদগ্ধ হয়ে বিছানায় কাতরাচ্ছেন।
ঢামেক বার্ন ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রোলবোমা ও বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ১৩ জন ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৪ জন চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেলেও ৮ জন এখনো ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে মাগুরার বাস হেলপার মুরাদ মোল্লা মারা গেছেন চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
গত ৭ জানুয়ারি রাতে মুরাদ বাসে ঘুমিয়ে ছিল। যশোর সদর এলাকায় দুর্বৃত্তরা বাসে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলে সে গুরুতর আহত হয়। এরপর তাকে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার শরীরের ৩৭ ভাগ পুড়ে যায়। রবিবার সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
রাজনৈতিক সহিংসতায় আহদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ সঙ্কর পাল। তিনি বলেন, ‘দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পোড়া রোগীদের অধিকাংশেরই শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণেই এ সব রোগীর ক্ষেত্রে ঝুঁকি অনেক বেশী।’
বার্ন ইউনিটের উপদেষ্টা ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে সরকার সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
ঢামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতায় রাজধানীর অন্তত ৫০ ব্যক্তি ঢামেক থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। সোমবারেই ককটেলের আঘাতে ১৩ ব্যক্তি ঢামেক থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পিকেটারদের আঘাতে আহত হয়ে ভর্তি হয়েছেন আরও ৫ জন। এর মধ্যে আতিকুর রহমান নামে এক ট্রাকচালক সোমবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
তার বড়ভাই জব্বার আলী জানান, নোয়াখালীর বজরা এলাকায় গত বুধবার পিকেটারদের ইটের আঘাতে গুরুতর আহত হন আতিকুর।
এ ছাড়া সোমবার নাশকতার সময় এক ব্যক্তিকে পুলিশ অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। রাজধানীর দক্ষিণখান থানা এলাকায় ফয়েজ আলী সরকার নামে ওই কর্মীকে পুলিশ অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। তবে দক্ষিণখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামীমুর রশীদ তালুকদার এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘নাশকতার সময় পুলিশ হাতেনাতে ফয়েজকে ধরে ফেললে ধস্তাধস্তির সময় তার পিস্তল থেকে গুলি বের হলে ফয়েজ গুলিবিদ্ধ হয়।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘রাজনৈতিক সহিংসতায় আহতদের চিকিৎসায় সরকার সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করছে। নিহতদের পবিরারকেও সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।’
অবরোধে নিরীহ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও জানান তিনি। তবে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা বিষয়টি তিনি নাকচ করে দেন।