ফোন ও বিবৃতিতে ক্ষতিগ্রস্ত বিএনপির আন্দোলন হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখেই নির্বাচনের প্রস্তাব!
চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ভারতের বিজেপি নেতা অমিত শাহের ফোন এবং চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের বিবৃতি নিয়ে সৃষ্টি পরিস্থিতি বিএনপির চলমান আন্দোলনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এই পরিস্থিতি উত্তরণে বিএনপি কৌশল বদলাতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আপাতত রক্ষণাত্মক কৌশল নিয়ে এগুতে পারে দলটি। বিএনপির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে এমন আভাস পাওয়া গেছে।
শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাবের পক্ষে নিজেদের অবস্থানের কথা চিন্তা করছে বিএনপি। এই প্রস্তাব বিষয়ে সংলাপের জন্য ক্ষমতাসীন সরকারি দলকে বার্তা দিবে বিএনপি। এই বার্তায় ক্ষমতাসীনরা সাড়া না দিলে কঠোর আন্দোলনে যাবে। সেক্ষেত্রে লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনে যাবে দলটি।
গত এক সপ্তাহের রাজনৈতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বিএনপি নির্বাচনের দাবি থেকে সরে এখন সংলাপ অনুষ্ঠানের দাবি জানাচ্ছে। মূলত ফোনালাপ এবং মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের বিবৃতি মিথ্যা হিসেবে মিডিয়ায় প্রচার পাওয়ার পরই বিএনপি নমনীয় হয়ে সংলাপে জোর দিচ্ছে।
অন্যদিকে, এই ঘটনার পর সরকারকে আরও কঠোর হতে দেখা গেছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের ঘটনাও বেড়ে গেছে। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে সরকারের কঠোর অবস্থানের বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, মিথ্যা ফোনালাপ এবং ভুয়া মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের বিবৃতির ঘটনা চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তার আগ পর্যন্ত বিএনপির অবস্থান ভাল ছিল। সরকারি দল সমালোচনায় ছিল। কিন্তু মিথ্যা আর ভুয়া বিবৃতির ঘটনায় এখন বিএনপিকে নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, ক্ষমতাসীনরা বেগম খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ এবং দলটিকে সভা-সমাবেশ করতে না দিয়ে, বিএনপিকে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। কিন্তু মিথ্যা, ভুয়া আর জালিয়াতির মতো একটি ভুল ঘটনা ঘটানোর কারণে বিএনপি আবার পিছিয়ে পড়ল। মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হওয়ার কারণে দলটি যে পরিমাণ আন্দোলনের জোয়ার আনতে পারত। এখন তাতে অনেকটাই ভাটা পড়ছে।
মিথ্যা ফোনালাপ এবং ভুয়া মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের বিবৃতির ঘটনা সম্পর্কে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেন, ‘মিডিয়ার মাধ্যমে যা জেনেছি, বিষয়টি সত্য হলে শুভকর নয়।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেন, ‘একটাই কথা, পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন প্রহসনের নির্বাচন। নতুন নির্বাচন দিতে হবে। অচলাবস্থা নিরসনে প্রধানমন্ত্রীকেই সংলাপের সূত্রপাত করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রয়োজনে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পটভূমি প্রস্তুত করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে থাকতে পারেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর একক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তখন থাকতে পারবে না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সংলাপে না বসলে আরও কঠিন আন্দোলনে যাব। এরই মধ্যে অসহযোগ শুরু হয়ে গেছে। সরকার যদি এখনো সুপথে না আসে তবে লাগাতার অসহযোগ শুরু হবে।’
জিয়া পরিষদের সাবেক সদস্য এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অভিজ্ঞ ও প্রবীণ অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘সংলাপ ছাড়া রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই। এ জন্য সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকেই উদ্যোগ নিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংলাপে বসলেই নির্বাচনের পথ সুগম হবে। প্রয়োজনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠন হতে পারে। কেননা, ইংল্যান্ড, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকার প্রধানকে রেখেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর অন্য দেশে এভাবে সম্ভব হলে আমাদের এখানে নয় কেন।’
সিনিয়র কূটনীতিক এবং সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. ফারুক চৌধুরী বলেন, ‘মিথ্যা ফোনালাপ এবং ভুয়া মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের বিবৃতির ঘটনা বাংলাদেশের জন্য লজ্জার, মানুষ হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার। এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে, বাংলাদেশের রাজনীতি এখনো বিদেশনির্ভর।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে আলোচনা বা সংলাপ করা। এক্ষেত্রে দুই দলকেই ছাড় দিতে হবে।’
স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতার কাছে মিথ্যা ফোনালাপ এবং ভুয়া মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের বিবৃতির ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।
দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি ও সমমান ২০ দলীয় জোট নিয়ে কাজ করছেন এমন একজন রিপোর্টার নাম প্রকাশ না করার শতে বলেন, ‘চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যেতে চায় ২০ দল। আন্দোলনের মধ্যে কোনো বিরতি চায় না তারা। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী চাচ্ছে আন্দোলনকে চূড়ান্ত পযায়ে নিতে টানা অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি চালিয়ে যেতে।’
ওই রিপোর্টার আরও বলেন, ‘সরকারবিরোধী আন্দোলন অতীতে সফল না হওয়ার পেছনে বিএনপির এক শ্রেণীর সিনিয়র নেতাকে দায়ী করছেন জোটের নেতারা। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার কয়েকজন উপদেষ্টা ও ভাইস চেয়ারম্যানের প্রতি ক্ষুব্ধ তারা। গুলশান অফিস ঘনিষ্ঠ এ সব সিনিয়র নেতার অতি বিদেশ নির্ভরতা ও খালেদা জিয়াকে ভুল বুঝানোর কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিকেন্দ্রিক সরকারবিরোধী আন্দোলন সফল হয়নি বলে মনে করেন জোট নেতারা।’
তিনি আরও বলেন, ‘খালেদা জিয়া এখন প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পেরেছেন। তিনি এও জানতে পেরেছেন— গুলশান অফিসকেন্দ্রিক কিছু সুবিধাবাদী নেতা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো বাইরে ফাঁস করে দেন। তাই এবার দলের কয়েকজ বিশ্বস্ত নেতা ও জোটের মধ্যে জামায়াত ও অন্য ২টি দলের দু-একজন নেতা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা কাউকে বলছেন না এবং বুঝতেও দিচ্ছেন না।’
তিনি বলেন ভারতের বিজেপির সভাপতি অমিত শাহের টেলিফোন ও মার্কিন কংগ্রেসম্যানের চিঠির বিষয় নিয়ে ধোঁয়ার মধ্যে রয়েছেন জোটের শরিকরাও। এ সব ঘটনার প্রকৃত অবস্থা আসলে কী এ নিয়ে তাদের কোনো পরিষ্কার ধারণা বা তথ্য নেই। তবে এ ব্যপারে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বিএনপির একাধিক নেতা দ্য রিপোর্টকে জানান, কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আদায়ের লক্ষ্যে বিশ্ব ইজতেমা শেষে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কঠোরতা আরও বাড়াবে। বাড়বে আন্দোলনের গতি। পাল্টাবে ধরন ও কৌশল। অনির্দিষ্টকালের অবরোধ গড়াতে পারে লাগাতার হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনে।