সংঘাতের মধ্যেই রাজনীতি ; শিগগির খুলছে না আলোচনার দুয়ার
সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে সোমবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের সমাবেশকে ঘিরে রাজনীতির নতুন বার্তা যারা আশা করেছিলেন, তাদের আশা পূরণ হয়নি। প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ হাসিনা আলোচনা কিংবা সংলাপের বিষয়টি মুখেই আনেননি। উল্টো বিরোধী জোটের নেত্রীকে ব্যক্তিগত আক্রমণে অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছেন।
চলমান অবরোধ কর্মসূচির মধ্যেও বিরোধী জোটের নেতা বেগম খালেদা জিয়া সংলাপের ইঙ্গিত দিলেও সরকার কিংবা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাবই আমলে নেওয়া হয়নি। দশ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হলেও বিশ্ব ইজতেমার কারণে দুই দিন পিছিয়ে সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জমায়েতের প্রতি নমনীয় মনোভাব দেখা গেলেও রাজনীতির মাঠে আরও কঠোর হওয়ার ইঙ্গিতই দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোমবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় বলেছেন, ‘ক্ষমতায় আসতে না পেরে বিএনপি দেশে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি জামায়াতের নৈরাজ্য ঠেকাতে প্রয়োজনে সব কিছু করব। বাংলার মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় যা যা করণীয় তাই করব।’
তিন জানুয়ারি সন্ধ্যা থেকে নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ বেগম খালেদা জিয়া। তার ডাকা টানা আন্দোলনে দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে টানা দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব নেওয়া সরকারকে গত এক বছরে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি। আওয়ামী লীগের সোমবারের সমাবেশ থেকে নতুন বার্তার অপেক্ষায় ছিলেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
জানতে চাইলে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে হতাশা প্রকাশ
করে বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যের প্রত্যাশা ছিল। জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে দেশবাসীকে উদ্বিগ্নতা থেকে মুক্ত করতে পারতেন তিনি। কিন্তু তার বক্তব্যে হতাশ হয়েছি।’
আগামী দিনের রাজনীতির পরিস্থিতির বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘দেশ আজ ভয়ঙ্কর সংঘাতের দিকে যাচ্ছে। জনজীবন বিপর্যস্ত, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে পারে না। ৫ জানুয়ারি সঠিক নির্বাচন হয়নি। তারপরও জোর করে একটি সরকারকে পাঁচ বছর টেনে নেওয়ার পরিণতি ভাল হবে না। পুরো দায় চাপবে সরকারের ঘারেই।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি তার বক্তৃতায় জনগণের জান রক্ষায় সব কিছু রক্ষার কথা বললেও পাচঁ জানুয়ারির পর থেকে দেশব্যাপী মানুষের জানমালের যে ক্ষতি হচ্ছে তা প্রতিরোধে সরকার কি সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারছে না? মন্তব্য জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, ‘আইনী প্রক্রিয়ায় আসলে সরকার মোকাবিলা করতে পারে। রাজনৈতিকভাবে আসলে আওয়ামী লীগ মোকাবিলা করতে পারে। কিন্তু চোরাগুপ্তা হামলা করলে তো অনেক সময় কিছু করা যায় না।’
এটাকে ব্যর্থতা মানতে নারাজ এই আওয়ামী লীগ নেতা আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সহ্যের একটা সীমা আছে। সরকার তো একটা সহনশীল অবস্থানে থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে। এতেও যদি সমাধান না হয় তাহলে তো কঠোর হতেই হবে।’
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নতুন কোনো দিকনির্দেশনার বদলে খালেদা জিয়ার প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণকেও দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তার মতে, ‘রাজনীতিতে ব্যক্তিগত কাদা ছোড়াছুড়ি থাকেই। কিন্তু সর্বোচ্চ পর্যায়ে ব্যক্তিগত আক্রমণের একটা পর্যায় থাকা উচিত।’
বর্তমান সরকারের এক বছরের মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক জনসমাবেশ করেছেন। কিন্তু পাঁচ জানুয়ারি যতই এগিয়ে আসছিল সরকার ততই বিএনপির প্রতি খড়গহস্ত হতে থাকে। গাজীপুরের পর ঢাকাতেও পুলিশের নিষেধাজ্ঞায় সমাবেশ করতে দেওয়া হয়নি বিএনপিকে। অথচ একই জায়গায় (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সরকার দলকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে সমাবেশ করতে দিল পুলিশ।
সরকারের এমন আচরণ দেশের পরিস্থিতিকে কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে? জানতে চাইলে সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘গত নির্বাচনের পর থেকে দেশ স্বাভাবিক রাজনৈতিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে বের হতে হলে আলোচনায় বসতেই হবে। যুদ্ধ শুরু হলেও আলোচনার মাধ্যমে শেষ হয়। রাজনীতিতেও তাই করতে হবে। আলোচনার বিকল্প নেই, পার্থক্য সময়ের।’
রাজনৈতিক সমঝোতার দায় সরকারি দলের ওপরই বেশী বর্তায় বলে মন্তব্য প্রায় সকল রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। এদিক থেকে বিএনপি চাইলেও আওয়ামী লীগ কেন আলোচনার সূত্রপাত করতে চাইছে না— এমন প্রশ্নের উত্তরে দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘রাজনৈতিক আলোচনা হতেই পারে। কিন্তু যারা চোরাগুপ্তা আন্দোলন করে, বাংলাদেশের বিপক্ষের শক্তি নিয়ে রাজনীতি করে তাদের সঙ্গে কীভাবে আলোচনা হয়? বিএনপি যদি তাদের জঙ্গিবাদী সঙ্গীদের ত্যাগ করতে পারেন তাহলে আলোচনা হতেই পারে।’