এবারও রোনালদোর ব্যালন ডি’অর
ঠিক কাটায় কাটায় সাড়ে এগারটায় ফিফার সদর দফতর জুরিখে জামজমকপূর্ণ আয়োজন শুরু হলেও তার মহেন্দ্রক্ষণ এসেছিল ঠিক দেড় ঘণ্টা পর। ফিফার প্রধানত আকর্ষণ ব্যালন ডি’অর ২০১৪ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে রাত ১টায়। সেখানে এবারও শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট শোভা পেয়েছে পর্তুগিজ ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ভাগ্যে।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে টানা ৩ বার ব্যালন ডি’অর জয়ী মেসির রাজত্বে হানা দিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।
এবার শেষ লড়াইয়ে খুব কাছাকাছি ছিলেন পর্তুগিজ তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, আর্জেন্টাইন লিওনেল মেসি ও জার্মানির রক্ষণভাগের দূর্গসুরক্ষী মানুয়েল ন্যয়ার।
জুরিখে আসরের শুরুটা ছিল একটু ভিন্ন আমেজের। আগে অন্যান্যদের পুরস্কার তুলে দেওয়া, ফিফা সভাপতির ভাষণ, ভিডিওচিত্রীর প্রদর্শণী, গানা-বাজনা অতঃপর ব্যালন ডি’অর ২০১৪ ঘোষণা। ওই ঘোষণা দেওয়ার আগে বর্ণিল মঞ্চের বিশাল স্ক্রিণে শেষ লড়াইয়ের ৩ তারকাদের নিয়ে প্রামাণ্যভিডিও প্রচার করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে ফিফা সভাপতি আবেগঘন মুহূর্তে বলেছেন, ‘এই পুরস্কার ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে বিশ্ব সম্প্রীতি-সৌহার্দও বজায় রাখতে হবে।’ অনুষ্ঠানের লাস্যময়ী উপস্থাপিকা ক্যাট অ্যাডো পুরো অনুষ্ঠান মাতিয়ে রেখেছেন তার সুললিত কণ্ঠে।
ন্যুয়ার না জিতলেও তার দেশ জার্মানি জিতেছে দুটি পুরস্কার। ফিফার বিশ্বকাপের কোচ হিসেবে পুরস্কার জিতেছেন জার্মানির জোয়াকিম লো। আর মহিলা ফুটবলে সেরা হয়েছেন জার্মানির নাদিন কেসলার। তিনি পেছনে ফেলেছেন ব্রাজিলের মার্তাকে। এ ছাড়া মহিলা ফুটবল দলের সেরা কোচ নির্বাচিত হয়েছেন রাফেল কেলারম্যান। আর পুসকাস পুরস্কার জিতেছেন ব্রাজিল বিশ্বকাপে আলোড়ন তোলা জেমস রদ্রিগেজ।
ফিফা ব্যালন ডি’অরের প্রবর্তন ২০১০ সালে। প্রথমবারেই এই পদক জিতেছেন আর্জেন্টিনার ফুটবল সুপারস্টার লিওনেল মেসি। ওই বছর দ্বিতীয় ও তৃতীয়স্থানে যথাক্রমে ছিলেন স্পেনের দুই তারকা ফুটবলার আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা ও জাভি। পরবর্তী ২ বছরও মেসির দখলেই থেকেছে ব্যালন ডি’অর। এই ২ বছর দ্বিতীয়স্থানে থেকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে পুর্তগালের সুপারস্টার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ২০১১ সালে জাভি এবং ২০১২ সালে ইনিয়েস্তাকে তৃতীয়স্থানে থেকে খুশি হতে হয়েছে। ২০১৩ সালে মেসির রাজত্বের ইতি ঘটিয়েছেন পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। জিতে নিয়েছেন ব্যালন ডি’অর; মেসিকে এবার খুশি থাকতে হয়েছে দ্বিতীয় হয়ে। আর বায়ার্ন মিউনিখের ফরাসি ফুটবল তারকা ফ্রাঙ্ক রিবেরি হয়েছেন তৃতীয়। প্রবর্তনের পর থেকে তাই ব্যালন ডি’অর হয়ে থেকেছে মেসি-রোনালদোরে দ্বৈরথে জমে ওঠেছে! সঙ্গে স্পেনের দুই বিশ্বসেরা ক্লাব বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের প্রতিনিধিদের জয়-জয়কার এখানে। কেবল একবারই জার্মান ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ এই রাজ্যে ঢুকতে পেরেছিল। এবারে অবশ্য ম্যানুয়েল ন্যয়ারের বদৌলতে আরেকবার বার্সা-রিয়ালের পাশে বায়ার্নও জায়গা করে নিতে পেরেছে ব্যালন ডি’অর জয়ের প্রতিযোগিতায়।
ব্যালন ডি’অর কি? ফুটবল ভক্ত মাত্রই সবার এটা খুব ভাল করেই জানা। তবে ব্যালন ডি’অরের পিছনের ইতিহাসটা হয়তো অনেকের নাও জানা থাকতে পারে। যারা এই ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন, তাদের জন্য বলা- প্রতিবছর একজন বিশ্বসেরা ফুটবলারকে পুরস্কৃত করার উদ্দেশ্যে ১৯৯১ সালে ‘ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার’ নামে একটি পদক প্রবর্তন করেছে ফিফা। আগের বছর ফুটবল মাঠে পারফরমেন্সের আলোকে কোচদের ভোটে বেছে নেওয়া হতো একজন সেরা ফুটবলারকে। প্রতি কোচ ৩টি করে ভোট (পজিশনাল ভোটিং সিস্টেমে) দিতে পারতেন। এই ৩টি ভোটের পয়েন্টমূল্য ছিল যথাক্রমে ৫, ৩ ও ১।
কোচদের ভোটাভুটি শেষ হওয়ার পর ফুটবলাররা যে পয়েন্ট অর্জন করতেন এর ভিত্তিতেই বেছে নেওয়া হতো বর্ষসেরা ফুটবলারকে।
‘ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার’ প্রবর্তনের পর প্রথম বিজয়ী হয়েছেন জার্মানির বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক লোথার ম্যাথুস (ইন্টার মিলান)। এর পর ক্রমান্বয়ে একে একে এই পদক জিতেছেন-নেদারল্যান্ডের মার্কো ফন বাস্তেন (এসি মিলান), ইতালির রবার্তো ব্যাজিও (জুভেন্টাস), ব্রাজিলের রোমারিও (বার্সেলোনা), যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ উইয়া (এসি মিলান ও প্যারিস সেন্ট জার্মেইন), ব্রাজিলের রোনালদো (৩ বার-১৯৯৬, ১৯৯৭ ও ২০০২; বার্সেলোনা, পিএসভি এডিনহোভেন, ইন্টার মিলান ও বার্সেলোনা), ফ্রান্সের জিনেদিন জিদান (৩ বার-১৯৯৮, ২০০০ ও ২০০৩; জুভেন্টাস), ব্রাজিলের রিভালদো (বার্সেলোনা), পর্তুগালের লু্ইস ফিগো (রিয়াল মাদ্রিদ), ব্রাজিলের রোনালদিনহো (২০০৪ ও ২০০৫; বার্সেলোনা), ফ্যাবিও ক্যানাভারো (রিয়াল মাদ্রিদ ও জুভেন্টাস), ব্রাজিলের কাকা (এসি মিলান), পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড) এবং লিওনেল মেসি (বার্সেলোনা)।
২০১০ সালে এই ‘ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার’ পদকই রূপান্তরিত হয়েছে ‘ফিফা ব্যালন ডি’অর’ পদকে। এই রূপান্তরের পিছনেও রয়েছে এক ইতিহাস। ফিফা যখন ১৯৯১ সাল থেকে বিশ্বসেরা একজন ফুটবলার নির্বাচন করতে শুরু করেছে, তখন অনেক বছর ধরেই ইউরোপের বর্ষসেরা ফুটবলারকে ‘ব্যালন ডি’অর’ নামে পদক প্রদান করে আসছিল ‘ফ্রান্স ফুটবল’ নামের একটি ম্যাগাজিন। সেরা ফুটবলার নির্বাচনে সহকর্মীদের ভোট বিবেচনা করতেন ম্যাগাজিনটির প্রধান লেখক গ্যাব্রিয়েল হ্যানো। ১৯৫৬ সালে প্রথম ব্যালন ডি’ওর প্রদান করে ফ্রান্স ফুটবল। পদক জিতেছেন ইংলিশ ফুটবলার স্যার স্ট্যানলি ম্যাথুস। এরপর একে একে অনেকেই এই পদক জিতেছেন। কিন্তু পদকটি কেবলমাত্র ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ফুটবলারদের জন্য নির্ধারিত ছিল। যে কারণে ব্রাজিলের কিংবদন্তী ফুটবলার পেলে বা আর্জেন্টিনার ফুটবল ঈশ্বর দিয়াগো ম্যারাডোনার ভাগ্যে ব্যালন ডি’অর জয়ের সৌভাগ্য হয়নি। তবে ১৯৯৫ সালে এই নিয়মে পরিবর্তন ঘটে; ইউরোপীয় দেশের নাগরিক না হলেও ইউরোপিয়ান কোনো ক্লাবে ফুটবল খেলার সুবাদে অন্যান্য মহাদেশের ফুটবলাররা ব্যালন ডি’অর জয়ের জন্য বিবেচনায় আসতে শুরু করে। জোহান ক্রুইফ, মিশেল প্লাতিনি ও মার্কো ফন বাস্তেন তিনবার করে এই পদক জিতেছেন। এর মধ্যে প্লাতিনি একমাত্র ফুটবলার যিনি একাধারে তিনবার এই পদক জিতেছেন। প্রথম নন-ইউরোপিয়ান ফুটবলার হিসেবে ১৯৯৭ সালে এই পদক জয় করেছেন ব্রাজিলের রোনালদো। তিনি দুবার (১৯৯৭ ও ২০০২)এই পদক জিতেছেন। এরপর নন-ইউরোপিয়ানদের মধ্যে পদকটি আরো যার জিতেছেন তারা হলেন-ব্রাজিলের রিভালদো, রোনালদিনহো, কাকা এবং আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি। সর্বশেষ মেসিই এই পদক জিতেছেন, ২০০৯ সালে। ২০০৮ সালে জিতেছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।
২০১০ সালে ‘ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার’ ও ‘ব্যালন ডি’অর’ পদক দুটি একীভূত হয়েছে। দুই পদকের সমন্বয়ে প্রবর্তিত নতুন পদকের নাম করণ করা হয়েছে ‘ফিফা ব্যালন ডি’অর’ পদক। গোটা বিশ্বের ফুটবলাররাই এই পদকের জয়ের জন্য যোগ্য।