সেলিম আল দীন
নাট্যকার, গবেষক ও শিক্ষক সেলিম আল দীন ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। তিনি বাংলা নাটকের ঐতিহ্যবাহী আঙ্গিক ও বিষয়কে নতুন করে তুলে ধরেছেন।
সেলিম আল দীন ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনীর সোনাগাজীর সেনেরখিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন৷ তিনি মফিজউদ্দিন আহমেদ ও ফিরোজা খাতুনের তৃতীয় সন্তান৷ বাবার চাকরির সূত্রে ফেনী, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রংপুরের বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করেন৷ ১৯৬৪ সালে ফেনীর সেনেরখিলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন৷ ১৯৬৬ সালে ফেনী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন৷ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন৷ দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালে ভর্তি হন টাঙ্গাইলের করটিয়ায় সাদত কলেজে৷ সেখান থেকে বিএ পাসের পর ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন৷ ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মধ্য যুগের বাংলা নাট্যরীতি নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর সেলিম আল দীন লেখক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৮ সালে কবি আহসান হাবিব সম্পাদিত দৈনিক পাকিস্তানে তার প্রথম প্রবন্ধ ছাপা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যুক্ত হন ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে। পড়াশোনা শেষে কপি রাইটার হিসেবে বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপীতে যোগ দেন। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। আমৃত্যু সেখানে কর্মরত ছিলেন।
সেলিম আল দীনের হাত ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সেলিম আল দীন ১৯৮১-৮২ সালে নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফকে নিয়ে গড়ে তোলেন গ্রাম থিয়েটার। তার অধিকাংশ নাটক মঞ্চায়ন করে ঢাকা থিয়েটার। ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে গড়ে তোলেন গানের দল ‘কহনকথা’।
রেডিওতে প্রচারিত সেলিম আল দীনের প্রথম নাটক ‘বিপরীত তমসায়’ (১৯৬৯)।
টেলিভিশনে প্রথম নাটক ‘ঘুম নেই’ (১৯৭০)। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়াকালে ‘এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা’ প্রথম মঞ্চায়িত হয়।
সেলিম আল দীনের উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন (১৯৭৫), বাসন (১৯৮৫), মুনতাসির, শকুন্তলা, কীত্তনখোলা (১৯৮৬), কেরামতমঙ্গল (১৯৮৮), চাকা (১৯৯১), হরগজ (১৯৯২), যৈবতী কন্যার মন (১৯৯৩), হাতহদাই (১৯৯৭), প্রাচ্য (২০০০), নিমজ্জন (২০০২), ধাবমান, স্বর্ণবোয়াল (২০০৭) ও পুত্র। গীতিনৃত্যনাট্যের মধ্যে রয়েছে স্বপ্ন রজনীগণ ও ঊষা উৎসব। টেলিভিশনের জন্য লিখেছেন ঘুম নেই (১৯৭০), অশ্রুত গান্ধার (১৯৭৫), শেকড় কাঁদে জলকণার জন্য (১৯৭৭), ভাঙনের শব্দ শুনি (১৯৮২-৮৩), গ্রন্থিকগণ কহে (১৯৯০-৯১), ছায়া শিকারী (১৯৯৪-৯৫), রঙের মানুষ (২০০০-২০০৩) ও নকশীপাড়ের মানুষেরা (২০০০)।
রেডিওয়ের জন্য লিখেছেন বিপরীত তমসায় (১৯৬৯), রক্তের আঙ্গুরলতা ও কীত্তনখোলা (১৯৮৫)।
গবেষণাধর্মী কাজের মধ্যে রয়েছে মহুয়া (১৯৯০), দেওয়ানা মদিনা (১৯৯২), একটি মারমা রূপকথা (১৯৯৩), কাঁদো নদী কাঁদো ও মেঘনাদ বধ (অভিষেক নামপর্ব)।
চিত্রনাট্যের মধ্যে রয়েছে চাকা (১৯৯৪), কীর্তনখোলা (২০০০) ও একাত্তরের যীশু (সংলাপ, ১৯৯৪)।
অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে দিনলিপি ও ভাঙা প্রেম অশেষ বিশেষ। তিনি বেশ কিছু গানও রচনা করেছেন। এ ছাড়া গবেষক ও নাট্যকার সাইমন জাকারিয়ায় সম্পাদনায় ছয় খণ্ডে তার রচনাসমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ভাষার একমাত্র নাট্যবিষয়ক কোষগ্রন্থ ‘বাংলা নাট্যকোষ’ সংগ্রহ, সঙ্কলন, প্রণয়ন ও সম্পাদনা করেছেন তিনি। তার রচিত ‘হরগজ’ নাটকটি সুয়েডীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এ নাটকটি ভারতের রঙ্গকর্মী নাট্যদল হিন্দি ভাষায় মঞ্চায়ন করেছে। তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক বই ‘গুরু ও চণ্ডাল’ লিখেছেন মাহবুব মোর্শেদ।
তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। উল্লেখযোগ্য হল বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), ঋষিজের সংবর্ধনা (১৯৮৫), কথক সাহিত্য পুরস্কার (১৩৯০ বঙ্গাব্দ), একুশে পদক (২০০৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩), আকাদেমি মঞ্চ কলকাতা (১৯৯৪), শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার (১৯৯৪), খালেকদাদ সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৪)ও মুনীর চৌধুরী সম্মাননা (২০০৫)।
১৯৭৪ সালে বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের একমাত্র সন্তান মইনুল হাসান অকালমৃত।