আতঙ্ক বাড়ছে জঙ্গি কায়দার হামলায়
চলতি অবরোধে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ছে জঙ্গি আদলে হামলা, নাশকতার ঘটনা। রাস্তায় দীর্ঘক্ষণ অবস্থানের বদলে চলছে ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতি। অনেকটা অ্যামবুশ স্টাইল। আর এসব ঝটিকা আক্রমণে জনমনে উদ্বেগ ও আতঙ্কের পারদও চড়ছে। বিচারকের বাসভবন লক্ষ্য করে ছোড়া হচ্ছে বোমা, আগুন দেওয়া হচ্ছে বাড়িতে। হাইকোর্ট থেকে উদ্ধার হচ্ছে বোমা, যা বিশেষ কৌশলে বইয়ের আড়ালে বিচারকক্ষে নেওয়া হয়েছিল। আইনমন্ত্রীর বাসায়ও ককটেল মারা হয়েছে। রেহাই পাচ্ছে না সাধারণ মানুষের বাহন, গাড়ি, বাস-ট্রাক। মানুষ মরছে, দগ্ধ হচ্ছে। সহায়সম্বল নাশ হচ্ছে। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের দাবি, রাজনৈতিক স্বার্থে ও সরকারকে বিব্রত করতে বিশেষ মহলের ছকে আতঙ্ক ও ভীতি ছড়াতেই এসব করা হচ্ছে। দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। সার্বিক এ পরিস্থিতি সম্পর্কে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, নাশকতা ও হামলার যে পরিবর্তিত রূপ লক্ষ করা যাচ্ছে, তা রুখতে না পারলে পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে যাবে। প্রায় এক দশক আগে জেএমবিসহ জঙ্গি সংগঠনের কর্মকাণ্ডের সময় দেশে যে ধরনের আতঙ্কজনক পরিবেশ ছিল, তা ফিরে আসবে।
আন্দোলনে জঙ্গি প্রভাবের ঘটনাগুলো রাজধানীসহ সারা দেশের মানুষকেই আতঙ্কিত করে তুলেছে। সরকারের পক্ষ থেকে নানা রকম আহ্বান জানানো হলেও ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা এখনো চোখে পড়েনি। গোয়েন্দা ও পুলিশ কর্মকর্তারা ‘সতর্ক’ রয়েছেন বলে দাবি করলেও চলতি মাসে একাধিক স্থানে তাঁরা নিজেরাই আক্রান্ত হয়েছেন। রাজশাহীতে পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে পেটানো হয়েছে। তাদের টহল গাড়ি ককটেল ও আগুনে আক্রান্ত হয়েছে বেশ কয়েক স্থানে। জনমনে ভীতি ছড়াতে এ রকম শতাধিক ঘটনা ঘটেছে সারা দেশে। সে ক্ষেত্রে পুলিশের তৎপরতা আপাতত সীমাবদ্ধ রয়েছে মামলা দায়েরের মধ্যেই। সরকারবিরোধী আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের এসব ঘটনায় দোষারোপ করা হলেও কারা ও কেন এ ধরনের তৎপরতায় শরিক হচ্ছে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা মেলেনি এখনো। গত এক সপ্তাহে কয়েকটি আদালতের পাশাপাশি বিমানবন্দর, টেলিভিশন ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ও বোমা উদ্ধারের ঘটনাও জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
সার্বিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে ব্যাংক কর্মকর্তা সাজিয়া আফরিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কর্মজীবী মানুষ হিসেবে আগেও হরতাল-অবরোধে অফিসে গিয়েছি, কিন্তু এখন ভয় বেশি লাগে। আগে যেখানে সভা অথবা মিছিল থাকত সে এলাকা এড়িয়ে চললেই হতো। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি, চোরাগোপ্তা হামলা হচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর, গণপরিবহনে। স্কুলবাসসহ শিশুর ওপরে এ ধরনের হামলা হতে পারে আশঙ্কায় বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সন্তানদের স্কুলেই পাঠাতে পারিনি।’
উৎকণ্ঠা জানিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘আগে রাজনৈতিক দলগুলোর নানা কর্মসূচিতে সহিংসতা, নাশকতা ঘটলেও সাধারণ মানুষ এতটা জিম্মি হয়নি। আন্দোলনকারীরা মাঠে না থেকে চোরাগোপ্তা হামলা করছে, রিকশা আরোহী, মোটরসাইকেল চালকরাও রক্ষা পাচ্ছেন না। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বললেও এসব সামলাতে পারছে না। উল্টো নিজেরাই আক্রান্ত হচ্ছে। তাই প্রতি মুহূর্ত ভয় নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।’
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, জঙ্গিদের অনুকরণে যে ধরনের অপরাধ ঘটানো হচ্ছে, তা পরিকল্পিত। তবে সরকার এ বিষয়ে সতর্ক আছে। এ ধরনের হামলা ও নাশকতার পরিকল্পনা যারা করছে, যারা অংশ নিচ্ছে তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি অপরাধী গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জনগণকে আতঙ্কিত না হয়ে এসব তৎপরতায় জড়িতদের শনাক্তে সহযোগিতার আহ্বান জানান প্রতিমন্ত্রী।
পুলিশ ও গোয়েন্দাদের দাবি, চোরাগোপ্তা বোমা হামলা ও নাশকতার মাধ্যমে একটি মহল আতঙ্ক ছড়াতে চাইছে। মূলত রাজনৈতিক স্বার্থ ও সরকারকে বিব্রত করতেই এসব কাজ করা হচ্ছে। আর দুর্বৃত্তরা হামলার টার্গেট হিসেবে বেছে নিচ্ছে বিচারক ও বিচারালয়সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। তাঁদের বাসভবন, এমনকি গ্রামের বাড়িতেও হামলা ও আগুন দেওয়া হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এ ধরনের হামলার ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে। তবে এরই মধ্যে ঘটে যাওয়া ‘অঘটন’ বিশ্লেষণ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে গতকাল পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলেও সংশ্লিষ্টরা জানান।
গত শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে দুই বিচারকের বাসভবনে ককটেল হামলার ঘটনা ঘটে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কে এম মোস্তাকিনুর রহমানের সরকারি বাসভবন ও জেলা দায়রা জজ কবিতা খানমের বাসভবন লক্ষ্য করে দুই ঘণ্টার ব্যবধানে ককটেল হামলা চালিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। শনিবার সন্ধ্যার এ হামলায় কেউ হতাহত না হলেও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বিচারালয় সংশ্লিষ্টরা ছাড়াও সাধারণ মানুষ।
হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী রেজাউল হকের ফেনীর বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে বুধবার রাতে। সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামে অবস্থিত বাড়িটিতে আগুনের এ ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে স্থানীয় যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন পাটোয়ারীকে। পলাতক আসামি হিসেবে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কোনো বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার না করার বিষয়ে একটি রিটের শুনানি শেষে আদেশ দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রেজাউল হকের বাড়িতে আগুন লাগানো হয় বলে সন্দেহ তদন্তসংশ্লিষ্টদের। এর পরদিন সন্ধ্যায় বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের ধানমণ্ডির বাসা লক্ষ্য করে ককটেল হামলা হয়। সেটিও এ রায়ের সূত্রে বলে গোয়েন্দাদের ধারণা।
শুক্রবার রাতে আইনমন্ত্রীর বনানীর বাসভবনের ভেতরে দুটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটলেও কেউ হতাহত হননি। তবে সেখানে রাখা গাড়ির কাচ ভেঙে যায়। রবিবার সুপ্রিম কোর্টের ভেতর থেকে পুলিশ উদ্ধার করে তিনটি বোমা। শনিবার রাতে গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন-অর-রশীদের কিশোরগঞ্জের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। সেখানে তাঁর ফুফুর বাড়িতেও হাতবোমা ফাটানো হয়।
হামলা ও নাশকতার এসব কৌশল প্রসঙ্গে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলেছেন, এক দশক আগে জেএমবির তৎপরতার সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের হামলা ও নাশকতার ঘটনা দেখা গেছে। তা শক্ত হাতে মোকাবিলা করেছে পরবর্তী সরকার। সম্প্রতি যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাতে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার চেয়ে প্রকাশ্য রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ জোরালো হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা এসব ঘটনা ঘটালে তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে কোনো উপায় নেই। আগের মতো এবারের ঘটনাও যদি সেদিকে মোড় নেয় এবং চলতে থাকে উদ্ভূত এ পরিস্থিতি- তাহলে তা যে আবার দেশময় দুর্দশার সৃষ্টি করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক উমর ফারুক বলেন, অপরাধীরা তাদের কৌশল বদল করে সময় ও নানা পারিপাশ্বর্িকতা বিবেচনায়। যেসব ঘটনা এ মুর্হূতে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে, তার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থ। কিন্তু রাজনীতির এসব কৌশলে জঙ্গিবাদ ভর করলে ভবিষ্যতে ভয়ংকর পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন যেমন অসম্ভব, তেমনি রাষ্ট্রের জন্য তা হয়ে উঠবে ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ। শুরুতেই এ ধরনের ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।