আন্দোলন সরাসরি মনিটরিং করছেন অবরুদ্ধ খালেদা

khaledaগুলশানে নিজ কার্যালয়ে গত ১২ দিন ধরে অবরুদ্ধ অবস্থায় আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। একই সঙ্গে তার সঙ্গে সেখানে অবরুদ্ধ হয়ে আছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক আইজি এমএ কাইয়ুম, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, সহকারী মাহবুব আল আমীন ডিউ, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানাসহ কয়েকজন মহিলা নেত্রী ও অফিস স্টাফ।
অবরুদ্ধ হওয়ার পর থেকে বিএনপি চেয়ারপারসনের দিনের বেশিরভাগ সময় সারাদেশে দলীয় নেতাকর্মী ও জোটের নেতাদের খোঁজখবর নিয়ে কাটে। এর বাইরে নামাজ ও বিভিন্ন দোয়া-দরুদসহ ধর্মীয় বইপুস্তুক পড়ে তার সময় কাটছে বলে কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান তাদের অবরুদ্ধ সময় সম্পর্কে বলেন, ‘কতটুকু হিংস্র ও স্বৈরাচারী হলে দেশের তিন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বর্তমান এই অবৈধ সরকার অবরুদ্ধ করে রাখতে পারে। শুধু অবরুদ্ধতাই নয়, সরকার দেশনেত্রীর প্রাণহানিরও চেষ্টা করেছে। তার ওপর বিষাক্ত পিপার স্প্রে ছুড়ে মেরেছে।’
সেলিমা বলেন, ‘দেশনেত্রী যেখানে গণতন্ত্রের মুক্তি, জনগণের মুক্তির জন্য এত কষ্ট করছেন, সেখানে আমাদের তো ন্যূনতম কষ্ট করতেই হবে। আমরা পরিবারের বাইরে আছি। যতটুকু পারছি বাইরের নেতাকর্মী যারা জীবনবাজি রেখে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন, তাদের খোঁজখবর নিচ্ছি; ম্যাডামকেও জানাচ্ছি। এছাড়া বাকি সময়ের বেশিরভাগই আমাদের নামাজ, দোয়া-দরুদ পড়ে এবং এখানে আটকেপড়া মহিলা নেত্রীদের সঙ্গে কথা বলে কাটছে। একজন আরেকজনের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিচ্ছি। এভাবেই মূলত আমাদের অবরুদ্ধ সময় কাটছে।’
গুলশানের ৮৬ নম্বর রোডের ৬ নম্বর বাড়িটি বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়। গত ৩ জানুয়ারি রাত থেকে তিনি সেখানে সরকারি নির্দেশে পুলিশের অবরোধের মধ্যে রয়েছেন। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত (বুধবার) তিনি ও তার সঙ্গে থাকা নেতানেত্রীরা সবাই সেখানে আটকা আছেন।
৩ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১১টার পর থেকে হঠাৎ করেই বিপুলসংখ্যক পুলিশ খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের প্রবেশ ও বাহির হওয়ার পথে ব্যারিকেড তৈরী করে। ২৪টি বালু, ইট ও কাঠবাহী বিশালাকার ট্রাকের পাশাপাশি পুলিশের জলকামান, পুলিশ বহনকারী ভ্যান, পিকআপ দিয়ে ৮৬ নম্বর রোডের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় পুলিশ। এ সব সরঞ্জাম আড়াআড়িভাবে রাস্তায় রেখে নির্ভেদ্য নিরাপত্তা জাল বিস্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সড়কে বসানো হয় পুলিশের তল্লাশি চৌকি। মূলত সে দিন থেকেই ওই সড়কে সাধারণ মানুষ ও যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সাংবাদিকদেরও পরিচয়পত্র দেখিয়ে ওই সড়কে প্রবেশ করতে হচ্ছে। ওই সড়কে সাংবাদিকদের যানবাহন প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
প্রথম কয়েক দিন একেবারেই কাউকে সেই কার্যালয়ে প্রবশে করতে দেওয়া না হলেও পরবর্তিতে দলের কিছু নেতা ও পেশাজীবীদের সীমিত আকারে অনুমোদনসাপেক্ষে কার্যালয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে।
মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা বলেন, ‘ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) যেখানে অবরুদ্ধ সেখানে আমাদের কষ্ট নিয়ে আমরা ভাবি না। দিনরাত কিভাবে যেন পার হয়ে যাচ্ছে। তবে সংসার, নিজের ঘর ফেলে এভাবে অবরুদ্ধ থাকা কারও জন্যই সুখের নয়। আমি এক জয়গায়, খোকন (শিরিনের স্বামী) আরেক জায়গায়, এটা তো কষ্টেরই বিষয়। তাছাড়া, এটা তো বাসাও নয়। একটি অফিস, এটাও মনে রাখতে হবে।’
শিরিন বলেন, ‘বেশিরভাগ সময় ম্যাডাম উপরে তার নিজের অফিস কক্ষে সময় কাটান। তিনি নামাজ, দোয়া-দরুদ ও বিভিন্ন বই ও পত্রপত্রিকা পড়েন নিয়মিত। এছাড়া তিনি প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্বৈরাচার হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। প্রয়োজনে আমাদের কাছে ডাকছেন, কিছু জানতে চাচ্ছেন। আমরা যতটুকু জানি তা উনাকে জানাই। কিছুক্ষণ তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। এভাবেই সময় পার হচ্ছে।’
খালেদা জিয়ার খাবার বিষয়ে মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন বলেন, ‘ম্যাডাম তো খুব কম খাবার খান। তিনি সকালে নিয়মিত পেপের জুস খান। নাস্তায় দুটো পাতলা গমের রুটি, সঙ্গে সবজি। এছাড়া মাঝে মাঝে তিনি একটু সুপ খেয়ে থাকেন। দুপুরে দু’মুঠো সাদা ভাত, মাছ, করলা ভাজি এবং ডালও খান। সন্ধ্যায় হালকা চায়ের সঙ্গে অন্য হালকা খাবার। এছাড়া রাতে তার জন্য আনা সাদা ভাত, মুরগি, মাছ, সবজি, ভর্তা, ডাল দিয়ে একটু খাবার গ্রহণ করেন।’ বাইরে থেকে ম্যাডামের জন্য যে খাবার আসে, তা তো আমরাই খেয়ে ফেলি- বলেন শিরিন।
জানা যায়, অবরুদ্ধ হওয়ার পর থেকে নিয়মিত খালেদা জিয়ার খাবার আসে তার বড় ছেলে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের শ্বশুরবাড়ি থেকে। ধানমন্ডি থেকে নিয়মিত দু’জন বিশ্বস্ত লোক খালেদা জিয়ার খাবার নিয়ে গুলশান কার্যালয়ে পৌঁছে দিয়ে যান। মাঝে মধ্যে খালেদা জিয়ার ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ার শামীম এস্কান্দার ও বড় বোন সেলিনা ইসলামের বাসা থেকেও খালেদা জিয়ার পছন্দের খাবার নিয়ে স্বজনরা আসেন।
জানা যায়, খালেদা জিয়া সকালে ফজরের নামাজ পড়ার পর কিছুক্ষণ বিভিন্ন ধর্মীয় বই পড়েন। এর পর নাস্তা করেন। দুপুরের আগ পর্যন্ত খবরের কাগজ ও টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে খবর দেখে সারাদেশের অবরোধের চিত্র দেখেন। সোফায় বসে মাঝে মধ্যে হালকা চা নেন। দুপুরের পর থেকে রাত পর্যন্ত সরাসরি আন্দোলন মনিটরিং করেন। দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের সারাদেশের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগযোগ করারও নির্দেশনা দেন। প্রয়োজনে নিজেও অনেক তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের আন্দোলনে উজ্জীবিত করেন। জোট নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন তিনি। কোনো নির্দেশনা থাকলে তাও জানান।
বিএনপি চেয়ারপারসনের খাবার বিষয়ে তারই প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান বলেন, ‘ম্যাডাম স্বল্প আহারী। তিনি সকালে নাস্তা ও রাতে খাবার খান। দুপুরে অল্প খাবার খান, হালকা চা পান করেন।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে ওই কার্যালয়ে আরও রয়েছেন- চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শামসুদ্দিন দিদার ও শায়রুল কবির খান। তারা নিয়মিত গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। দলীয় নেতাদের কার্যালয়ে আসা-যাওয়ায় পুলিশ বাধা দিলেও তাদের আসা-যাওয়া তেমন কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয় না।
শায়রুল কবির খান জানান, চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের আমরা দু’জন (দিদার ও শায়রুল) চেয়ারপারসনের নির্দেশে সর্বক্ষণিক গণমাধ্যমকর্মীদের নানা রকম তথ্য সরবরাহসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতার জন্য নিয়োজিত আছি।
তিনি বলেন, চেয়ারপারসন আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা গণমাধ্যমকর্মীদের যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। যতটুকু পারা যায় ততটুকু তথ্য ও সহযোগিতা করতেও তিনি আমাদের সজাগ থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।
এছাড়া শামসুদ্দিন দিদার জানান, ‘সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা গণমাধ্যমকর্মীদের দেখভাল করতে ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা সেই নির্দেশের আলোকে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
এদিকে, গত ৩ জানুয়ারি থেকে নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ হওয়ার পর থেকেই গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর রোডের ১ নম্বরে খালেদা জিয়ার ভাড়াবাড়ি ‘ফিরোজা’ এখন জনমানবশূন্য। তার কয়েকজন ব্যক্তিগত স্টাফ ওই বাড়ির বর্তমান বাসিন্দা। বাইরে দু’জন পুলিশ কনস্টেবল পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend