রুদ্ধ হওয়ার পথে বাংলাদেশের গণতন্ত্র : সকলে উদ্বিগ্ন
বাংলাদেশে গণতন্ত্র রুদ্ধ হওয়ার পথে, এমন শঙ্কায় সকলে উদ্বিগ্ন। চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা, বড় একটি রাজনৈতিক দলকে সমাবেশ করতে না দেওয়া, দলটির প্রধান নেতাকে অবরুদ্ধ করে রাখা এবং রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় প্রাণহানি ও জানমালের ক্ষতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশী ও বিদেশীরা।
পাশাপাশি সহিংসতা বন্ধে এবং গণতন্ত্রের যাত্রা অব্যাহত রাখতে অনতিবিলম্বে সংলাপের উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
গণতন্ত্র বিপন্ন অবস্থা উল্লেখ করে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ, মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা বুধবার এ উদ্বেগের কথা জানান। পাশাপাশি রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণহানি এবং জানমালের ক্ষতির ঘটনায় সরকারের নিন্দা জানানো হয়।
এ পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) মো. সাখাওয়াত হোসেন বুধবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘দেশে বর্তমানে যা চলছে তাতে অশুভ কোনো শক্তির উদয় হলে অস্বাভাবিক হবে না। রাজনীতিবিদদের জন্যই আজ এ অবস্থা। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তাদেরই সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে, বিশেষ করে সরকারি দলের ওপরই তার দায় বর্তায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর আগেও দেখা গেছে, রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারণে বিভিন্ন সময়ে অশুভ শক্তির উদয় হয়েছে। এবারও যদি তারা সমাধান না করতে পারেন, তাহলে সামনের দিনে আরও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণে অনতিবিলম্বে দুইটি বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হওয়া প্রয়োজন। সরকারি দলকেই সংলাপের উদ্যোগ নিতে হবে। নতুবা এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল মাথাচাড়া দিতে পারে, অশুভ বা তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটতে পারে, যা দেশের জন্য শুভকর হবে না।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, ‘চলমান অবরোধ কর্মসূচি এবং হামলা ও ধরপাকড়ের ঘটনায় জনজীবনে যে দুর্ভোগ নেমে এসেছে, তাতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) উদ্বেগ ও নিন্দা জানাচ্ছে। ৪ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংস ঘটনায় ১৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে। সর্বশেষ রংপুরে চলন্ত বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে শিশুসহ চারজনকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। চোরাগোপ্তা হামলার কারণে জনমনে ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘বিরোধী দলকে সমাবেশ করতে না দেওয়া, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড়, সংবাদমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মানুষের অধিকার অগণতান্ত্রিকভাবে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। অবিলম্বে এ অবস্থার অবসান চাই।’
এদিকে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের তরফ থেকে ঢাকায় অবস্থান করা ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ডেকে ব্রিফ করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীসহ সংশ্লিষ্টরা ওই ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন।
কূটনীতিক সূত্রে জানা গেছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্রিফিংয়ে বিদেশী রাষ্ট্রদূতরা গভীর উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ, বড় রাজনৈতিক দলকে সমাবেশ করতে না দেওয়া এবং চলমান সহিংসতায় হত্যা ও জানমালের ক্ষতির কথা উল্লেখ করেন কূটনীতিকরা।
কূটনীতিক একটি সূত্র জানায়, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশ প্রধান ও রাষ্ট্রদূত পিয়েরি মায়াডন ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনতিবিলম্বে সহিংসতা বন্ধে এবং গণতন্ত্রের যাত্রা পুনরুদ্ধার করতে সরকারের প্রতি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। সরকারি কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের গণতন্ত্র রুদ্ধ হওয়ার পথে উল্লেখ করে মায়াডন বর্তমান পরিস্থিতির কঠিন সমালোচনা করেন।’
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘সরকারের গত এক বছরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্রিফ করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছিল।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বুধবার রাতে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি পাঠায়। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের ডেকে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করেন।
এ সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে চলমান সহিংসতার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করা হলে আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করেছে। জামায়াতে ইসলামী এবং হেফাজতে ইসলাম গত বছর নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংসতা কার্যক্রম চালিয়ে ব্যাপক হত্যা ও জানমালের ক্ষতি করেছে। অথচ বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এই দল দুটিকে সমর্থন দিয়ে সহিংস কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘ব্রিফিংয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সামনে সরকারের সাফল্য তুলে ধরা হয়। বলা হয়, সরকার বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে এবং গণতন্ত্রের যাত্রা অব্যাহত রাখতে বদ্ধপরিকর।’
এ সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বিএনপি নেতার সঙ্গে ভারতের বিজেপি নেতার ফোনালাপ কেলেঙ্কারি এবং মার্কিন কংগ্রেস ম্যানদের ভুয়া বিবৃতির প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
মন্ত্রী ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের জানান, বিএনপির সিনিয়র নেতা তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচার না করতে সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে মিডিয়াকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেননা তারেক রহমান বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তিনি পলাতক অবস্থায় বিবৃতি দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করছেন।
বিএনপি চেয়ারপরসনের উপদেষ্টা এবং সাবেক পররাষ্ট্র সচিব রিয়াজ রহমানের ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের বলেন, ‘এ ঘটনার তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে।’
এদিকে, বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি সহিংসতা বন্ধ এবং গণতন্ত্রের যাত্রা অব্যাহত রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছে।