সরকারবিরোধী আন্দোলন : ছাত্র ঐক্য গঠনে তোড়জোড় শিবিরের, অনাগ্রহী ছাত্রদল
সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলন বেগবান করতে ২০ দলীয় জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনের তোড়জোড় শুরু করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। তবে আগের মতোই এ ব্যাপারে অনাগ্রাহী ২০ দলের প্রধান শরিক বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
২০ দলীয় জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠন সূত্রে জানা যায়, সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনের জন্য জোটভুক্ত ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে ছাত্রশিবির। এ জন্য জোটভুক্ত ছাত্র সংগঠনগুলোর সভাপতি বা সেক্রেটারির সঙ্গে আলাদাভাবে বসে বা মোবাইলে শিবিরের পক্ষ থেকে ছাত্র ঐক্য গঠনে মতামত নেওয়া হচ্ছে। চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের গুরুত্ব তুলে ধরা হয় জোটভুক্ত ছাত্র সংগঠনগুলোর কাছে। শিবিরের কেন্দ্রীয় সাহিত্য সম্পাদক ইয়াসিন আরাফাত ২০ দলভুক্ত ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি জোটের প্রধান শরিক বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে শিবির। কয়েক দফায় ছাত্রদলের একাধিক নেতার সঙ্গে মোবাইলে কথাও বলেছেন ইয়াসিন আরাফাত। কিন্তু ছাত্রদলের পক্ষ থেকে তেমন সাড়া পাননি তিনি।
সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মনির আহমেদ। তবে এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
এ বিষয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক আব্দুস সাত্তার পাটোয়ারি মঙ্গলবার দুপুরে বলেন, ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনের বিষয়ে আমাদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হচ্ছে। ২০ দলের অনেকেই চাচ্ছেন একসঙ্গে আন্দোলন করতে। এটা তো হঠাৎ করে করা সম্ভব হবে না। বসতে হবে; বসার সুযোগ তো থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের চেয়ারপারসনকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত ও গণতান্ত্রিক চলমান আন্দোলনে মাঠে আছি। অন্যরাও যার যার মতো করে মাঠে আছে। আপাতত ছাত্র ঐক্য গঠনের বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না।’
সূত্র জানায়, সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনে শিবিরের এ তৎপরতায় ২০ দলের শরিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের নেতারা ইতিবাচক সাড়া দিলেও এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না ছাত্রদল। ছাত্রদলের বর্তমান নেতৃত্ব মনে করে ২০ দলভুক্ত ছাত্র সংগঠনের অধিকাংশই শিবিরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য হলে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার হবে ঠিক, এর চেয়ে বেশি লাভবান হবে শিবির। এ ছাড়া ছাত্রদলের মধ্যে একটি বড় অংশ রয়েছে যারা বরাবরই শিবিরবিরোধী।
জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির চলমান আন্দোলন জোরদার করতে ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ বিরোধী আন্দোলনে সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোর আদলে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনের জন্য তৎপর রয়েছে। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল মূলত ছাত্র সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কারণে। এ ছাড়া ২০০০-২০০১ সালেও আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনেও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতৃত্বে গঠিত ছাত্র ঐক্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তখনকার ছাত্রদলের সভাপতি নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর (বর্তমান কারাগারে) নেতৃত্বে গঠিত ছাত্র ঐক্যে শিবির ছাড়াও আরও কয়েকটি আওয়ামী লীগ বিরোধী ছাত্র সংগঠন সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে ভূমিকা রেখেছিল। তবে ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে আর এ ঐক্য দেখা যায়নি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যায়। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি করাসহ সারাদেশে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় সরকার। জামায়াত-শিবিরও রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামে।
২০ দলভুক্ত একাধিক ছাত্র সংগঠনের নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য রিপোর্টকে জানান, ২০১২ সালে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনের উদ্যোগ নেয় ছাত্রশিবির। ওই সময়ের ছাত্রশিবিরের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন জোটভুক্ত ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিয়ে একটি বৈঠকও করেছিলেন। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে ওই বৈঠকে দাওয়াত দিয়েছিল শিবির। সমমনা দলগুলোর প্রায় সব ছাত্র সংগঠনের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকরা শিবিরের ডাকে ওই বৈঠকে উপস্থিত হলেও অনুপস্থিত ছিল শুধু ছাত্রদলের নেতারা। জোটের মূল দল বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল নেতাদের ওই বৈঠকে অনুপস্থিতির কারণে ছাত্র ঐক্য গঠনে শিবিরের তখনকার প্রচেষ্টা আর সফল হয়নি।
এ ব্যাপারে ২০ দলের শরিক জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির ছাত্র সংগঠন জাগপা ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুথান থেকে শুরু করে অতীতের প্রতিটি সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল। বর্তমান স্বৈরাচার সরকারবিরোধী আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতেও জোটভুক্ত ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন খুবই জরুরি। আমি ব্যক্তিগতভাবে অতীতে অনেকবার সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম কিন্তু তা গঠন সম্ভব হয়নি। আমার মনে হয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যদি মনে করেন যেকোনো মুহূর্তে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন সম্ভব হবে।’
বাংলাদেশ ন্যাপের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক এমএন শাওন সাদেকী বলেন, ‘সকল গণতান্তিক আন্দোলনে ছাত্র সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সুতরাং চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন সময়ের দাবি।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্রশিবিরসহ জোটের শরিক দলের ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনের বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। যেহেতু ছাত্রদল ২০ দলের প্রধান শরিক বিএনপির ছাত্র সংগঠন। তাই ছাত্র ঐক্য গঠনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকেই মূল উদ্যোগ নিতে হবে। ছাত্রদল উদ্যোগ না নিলে তো আর হবে না।’
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্রকল্যাণ পার্টির সাধারণ সম্পাদক শেখ এনামুল হাসান তানিম বলেন, ‘চলমান আন্দোলন বেগবান করতে হলে ছাত্র সংগঠনগুলোর ঐক্য জরুরি। এ ব্যাপারে জোটের প্রধান ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ভূমিকাই মুখ্য হওয়া উচিত।’
জোটভুক্ত ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন হচ্ছে কিনা- জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি রাজিব আহসান বলেন, ‘এই মুহূর্তে তা বলতে পারছি না। আওয়ামী সরকারবিরোধী সংগঠনগুলো যার যার অবস্থান থেকে কাজ করছে। ছাত্রদল বিএনপির সহযোগী সংগঠন। আমরা ছাত্রদের বিষয়গুলো নিয়ে যেমন কাজ করি তেমনি বিএনপি যেহেতু মাদার সংগঠন, তাই তাদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে আমরা আছি।’