দেশে মাদকদ্রব্যের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণহীন
নেশাজাতীয় সব ধরণের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও দেশে এর প্রবেশ ও ব্যবহার ঠেকানো যাচ্ছে না। দেশের অভ্যন্তরে ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের প্রবেশ ও ব্যবহার বাড়ছে ভয়াবহভাবে। পাশ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে সীমান্তপথে আসা মাদকদ্রব্যের প্রবেশ ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৈরি ২০১৪ সালের যৌথ বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সারাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ৮ লাখ ৬১ হাজার ৮১ ইয়াবা, ২৯ হাজার ৯৬১ বোতল ফেনসিডিল, ৩ হাজার ৯৬৫ কেজি ৫৯১ গ্রাম গাঁজা আর সাত কেজি ৬৮০গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করা হয়।
অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাদক সেবনে বছরে ব্যয় হয় প্রায় চার হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। দেশে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ মাদক সেবন করছে। বাংলাদেশের মোট মাদকসেবীর ৫০ ভাগেরও বেশি ইয়াবা ব্যবহার করছে।
দেশে ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ মাদকদ্রব্য আসছে সীমান্তপথে ভারত ও মিয়ানমার থেকে। বিশেষ করে সমুদ্রপথে প্রচুর ইয়াবা আসছে দেশে। আর এর সবচেয়ে বড় প্রবেশপথ হচ্ছে কক্সবাজার ও টেকনাফ। যা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আমির হোসেন কে বলেন, দেশে বর্তমানে অন্যান্য মাদকের তুলনায় বেশি প্রবেশ করছে ইয়াবা। দেশের ভেতর ইয়াবা প্রবেশের মূল রুট হচ্ছে কক্সবাজার ও টেকনাফ সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে। আর এই সীমান্তের অধিকাংশই সমুদ্র পথ। তাই কোস্ট গার্ড, পুলিশ ও বিজিবির পক্ষে সর্বক্ষণ এত বিশাল সমুদ্র এলাকায় পাহারা দেয়াও সম্ভব নয়। তাই দেশে ইয়াবা এবং অন্যান্য মাদকদ্রব্যের নেশা থেকে যুবসমাজকে রক্ষায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
এ বিষয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু কে বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করছে। মাদককে দেশ থেকে উচ্ছেদ করতে আইনী পদক্ষেপ ছাড়াও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
রাজনীতির সাথে জড়িতরা মাদক সেবন ও ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা দুর্বৃত্তায়নের সাথে সাথে মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়ে। তাই তাদের চিহ্নিত করে মাদকের নেশা থেকে মুক্ত করে দলকে ও দেশকে মাদকমুক্ত করতে হবে।
সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী বলেন, ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা দিয়ে মাদকদ্রব্য যাতে দেশে ভেতর প্রবেশ করতে না পারে তাই বিজিবির লজিস্টিক (সরঞ্জাম) সাপোর্ট বাড়াতে হবে। কারণ আমাদের দীর্ঘ বর্ডার লাইনে অনেক স্থানে বিজিবির শক্তিশালী পোষ্ট নেই। তাই এক্ষেত্রে বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে। সীমান্ত এলাকায় টহল দিতে রাস্তা নেই ফলে সীমান্ত বাহিনীর পক্ষে অনেক স্থানে পৌঁছানো সম্ভব হয় না।
প্রতিবেদনে উঠে আসে, উদ্ধার হওয়া মাদক দ্রব্যের মধ্যে অন্যান্য মাসের তুলনায় ডিসেম্বরে ছিল সর্বোচ্চ। এরমধ্যে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৪০৩ ইয়াবা ট্যাবলেট, ৬৬৫০ বোতল ফেনসিডিল, ৪০২ কেজির বেশি গাঁজা ও ১ কেজিরও বেশি হেরোইন উদ্ধার করা হয়। যা জানুয়ারিতে ছিল ১২ হাজার ৯৪০ ইয়াবা ট্যাবলেট, ১ হাজার ৭৮ বোতল ফেনসিডিল, ২৫২ কেজির বেশি গাঁজা ও সাতশ’ গ্রামের বেশি হেরোইন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো দাবি করেছে, সরকারি এই হিসাব কেবল উদ্ধারের। বাস্তবে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার রয়েছে কয়েকগুণ। যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সারাদেশে চলে যাচ্ছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গতবছর অন্যান্য মাসের মধ্যে জানুয়ারিতে দেশে ইয়াবা উদ্ধারের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৯৪০, ফেব্রুয়ারিতে ৯৮ হাজার ৩৪১, মার্চে ৫১ হাজার ৪৭৬, এপ্রিলে ৬৬ হাজার ৮৪৪, মে মাসে ১২ হাজার ৪৭০, জুনে ১৩ হাজার ৩৩২, জুলাইতে ১৫ হাজার৪৫৩, আগস্টে ১৭ হাজার ৫৮৯, সেপ্টেম্বরে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪৫, অক্টোবরে ৯ হাজার ৭৫৪ এবং নভেম্বরে ১৮ হাজার ৮৩৪ ট্যাবলেট।
ইয়াবা, ফেন্সিডিল, গাঁজা, হেরোইন ছাড়াও বিদেশি মদ, দেশি মদ, বিয়ার, নেশা জাতীয় ইনজেকশন, প্যাথেডিন ইনজেকশন, গাঁজার গাছ, নেশা জাতীয় সিরাপ এবং কোরেক্সও উদ্ধার করা হয় বিভিন্ন পরিমাণ।
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে ২০১৪ সালে সারাদেশে ১০ হাজার ৭০২টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় আসামী করা হয় ১১ হাজার ৫০৯ জনকে। অপরদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত মামলা হয় ৬ হাজার ৬৯৩টি। এসবে আসামী করা হয় ৭ হাজার ৫৭৮জনকে।
মাদকদ্রব্যের ব্যবসা ও পরিবহনের সময় আটকদের মধ্যে ৫ হাজার ৭২৪ জনকে কারাদণ্ড এবং ১ হাজার ৪৫৪ জনকে অর্থদণ্ড করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, তালিকার পর তালিকা করা হচ্ছে অথচ ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত রাঘোব-বোয়ালদের অদৃশ্য কারণে ধরতে পারছে না আইনরক্ষাকারী সংস্থাগুলো। এক দিকে ইয়াবা, ফেন্সিডিল, গাঁজা এবং হেরোইনের বড় বড় চালান ধরা পড়ছে আর অন্যদিকে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বড় বড় চালান নিয়ে আসছে ইয়াবা মাফিয়ারা।
সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় পাচারকারীরা ধরা পড়লেও সিন্ডিকেটের মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে। ফলে দেশে মাদকদ্রব্যের জোয়ার বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। সম্প্রতি উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মাদকসেবীদের কাছে ইয়াবা, ফেন্সিডিল, গাঁজার ব্যবহার বেড়ে গেছে। ফলে বাড়ছে মাদকদ্রব্য চোরাচালান।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে এমন সংস্থাগুলো বলছে, এখনই মাদক ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হলে যুবসমাজ আরো ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার ও ব্যবসায়ী গ্রেফতার হচ্ছে। কিন্তু এরপরেও দমানো যাচ্ছে না। গ্রেফতারকৃতরা সহজেই জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারো একই কাজে জড়িয়ে পড়ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের ভেতরে ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরণের মাদকদ্রব্য প্রবেশের বড় রাস্তা হচ্ছে কক্সবাজার। এই জেলায় ৮০৭জন মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে টেকনাফ উপজেলাই ৭৬০ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে। এছাড়া সীমান্তবর্তী ৩২টি জেলার মধ্যে ২১টি জেলার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে- রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, নওগা, নীলফামারি, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাও, পঞ্চগড়, সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, বি-বাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি। অবশিষ্ট জেলাগুলোরও তালিকা দ্রুত সম্পন্ন করতে কাজ চলছে।
গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের মংডুতে বাংলাদেশ সীমানার ১০ কিলোমিটারের ভেতরে ইয়াবার কারখানা রয়েছে। এখন চোরাপথে সবচেয়ে বেশি আসা পণ্য হচ্ছে ইয়াবা। কক্সবাজার হয়ে আসা ইয়াবা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহনে কাজ করছে রোহিঙ্গারা। সম্প্রতি কিছু স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এবং নারীও ইয়াবা পাচারের সময় ধরা পড়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশে মাদকদ্রব্যের নিয়ন্ত্রণে মাদক ব্যবসায়ী, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ডাটাবেজ তৈরি করছে র্যাব।
সম্প্রতি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর পাশাপাশি দেশে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রাখতে সুপারিশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।