দীর্ঘ হচ্ছে লাশের মিছিল, প্রয়োজন সহনশীলতা
বাদাম বিক্রেতা রহিম বাদশা (৪৫)।
বাড়তি আয়ের আশায় মাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিল বাদাম, বুট, চাল, ডালি ও কুলা। আশা ছিল বিশ্ব ইজতেমায় বাদাম, বুট বিক্রি করে লাভ নিয়ে বাড়িতে ফিরবেন। কিন্তু তার সে আশা নিমেষেই ধূলিসাৎ করে দিয়েছে টানা অবরোধ।
রংপুর মিঠাপুকুরের উলিপুর থেকে মঙ্গলবার মধ্যরাতে ছেড়ে যাওয়া খলিল স্পেশাল নামের নাইট কোচের ওপর অবরোধকারীদের ছোড়া পেট্রোল বোমা তাদের সে স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছে। দুর্বৃত্তদের ছোড়া জ্বলন্ত আগুনে বাসের ভেতরেই পুড়ে মারা যান মা রহিমা ও রহিম বাদশা। তাদের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার ধামশ্রেণী ইউনিয়নের দরিচর গ্রামে।
রহিম বাদশার বড় ছেলে লিটন ঢাকায় একটি গার্মেন্টসে চাকরি করেন। ছোট ছেলে লিমন দাঁড়িকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। একমাত্র মেয়ে রুমি তবকপুর ফাজিল মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। বাদাম বিক্রি করেই ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করার স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু তার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।
জীবনের মায়া তুচ্ছ করে বেঁচে থাকার তাগিদে রাস্তায় নামেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। তাদের মধ্যে গত ১১ দিনের টানা অবরোধে ঝরে গেছে ২৪টি তাজা প্রাণ, দীর্ঘ হচ্ছে লাশের মিছিল। যারা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন, শুধুমাত্র পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে তারা রাস্তায় নামেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তার বক্তৃতায় বেশ কয়েকবার ‘দেশের জনসংখ্যা সমস্যা নয়, সম্পদ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের অবরোধ ও উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেই সম্পদই বলি হচ্ছে বার বার। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর এ বিষয়ে যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। ওই তাজা প্রাণগুলোর দায় নিতে চাচ্ছেন না নেতানেত্রীরা।
সরকারি দল আওয়ামী লীগ দায় চাপায় বিএনপির ওপর আর বিএনপি চাপায় সরকারি দলের ওপর। এর মধ্য দিয়ে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হতে চলেছে। কিন্তু এ মিছিল থামিয়ে দিতে সহনশীলতা, দায়িত্বশীলতা বা জনগণের প্রতি মমত্ববোধের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে এগিয়ে আসছে না কোনো রাজনৈতিক দল। ফলে জানমালের ক্ষতি সাধন তো হচ্ছেই অর্থনীতিও ধ্বংস হচ্ছে। আতঙ্কও তাড়া করে ফিরছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের মধ্যে।
বাদাম বিক্রেতা রহিম বাদশার ছেলে ও মেয়ের আহাজারি
এ পরিস্থিতিতে সকলেরই প্রশ্ন, ‘এর শেষ কোথায়। কবে থামবে এই মৃত্যুর মিছিল, আতঙ্ক কাটবে কবে, স্বস্তি কখন ফিরবে।’ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ৫ জানুয়ারি দেশব্যাপী অবরোধের ডাক দেয়। টানা অবরোধের কবলে পড়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২৪ জনের প্রাণহানির পাশাপাশি প্রায় পাঁচ শতাধিক যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ নিয়ে পেশাজীবী, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বিশিষ্টজনের সঙ্গে আলাপকালে উঠে এসেছে তাদের ক্ষোভের কথা, সমাধানের কথা। রাজনৈতিক দলগুলো এর দায় এড়াতে চাইলেও বিশিষ্টজনেরা রাজনৈতিক দলগুলোকেই দায়ী করছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলী খান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো যখন দায় এড়িয়ে চলেন, তখন মনে হয় দায় সমগ্র জাতির। কেন তারা ওই দলগুলোকে ভোট দেন। সেই অপরাধেই তাদের জীবন দিতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে সহনশীলতা, সমঝোতা ও আলোচনাই কেবল এই মৃত্যুর মিছিল ও অর্থনৈতিক ক্ষতির হ্রাস টানতে পারে। অন্য কোনো উপায়ে নয়। আন্দোলনের নামে যা ঘটছে, সরকারি দল ও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো যা বলছে কোনটাই গ্রহণযোগ্য নয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলতাই কেবল উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে পারে। তাদের দেশপ্রেম, বুদ্ধিমত্তা, জনগণের প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রত হলে খেটে খাওয়া মানুষের করুণ মৃত্যু বন্ধ হতে পারে।’ তিনি এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় বসারও তাগিদ দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কেবল ‘ক্ষোভ’ই প্রকাশ করেন। এর বাইরে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে রাজি হননি তিনি।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘যত দিন দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আর বিপক্ষের শক্তি চিহ্নিত না হবে তত দিন এ সমস্যা থাকবে। মৌলিক এ বিষয়ের সমাধান হলেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। এ ছাড়া সমাধানের উপায় অসম্ভব।’
জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘আলোচনাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে। আতঙ্ক, অস্বস্তি ও অনাহুত মৃত্যু সবকিছুরই সমাধান সংলাপের ভেতর দিয়ে আসবে। এর জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন প্রয়োজন।