দুই দলেই চলছে সংলাপের ‘আলোচনা’
সংলাপের আলোচনা চলছে দুই দলেই। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের সংলাপের বিষয়ে ‘আগ্রহ প্রকাশ’ আর আওয়ামী লীগের ‘অনাগ্রহ’।
তবে নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, দুই দলের আগ্রহ-অনাগ্রহ থাকলেও সংলাপ নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলের মধ্যে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
আন্তর্জাতিক মহলেও সংলাপ নিয়ে চলছে আলোচনা। সাম্প্রতিক সময়ে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বিকল্পধারাসহ বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে সংলাপের প্রস্তাব আসায় নতুন করে এর আবেদন সৃষ্টি হয়েছে। এ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাও সংলাপ নিয়ে বিভিন্ন যোগসূত্র মেলাতে শুরু করেছেন।
আওয়ামী লীগ নেতাদের একটি অংশ নাকচ করে আসলেও অপর একটি অংশের মতে, এ প্রস্তাবের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং স্থানীয় সরকারমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মুখ থেকে কোনো বক্তব্য না আসায় অপর অংশটি (বর্ষীয়ান নেতারা) সংলাপের সম্ভাবনা দেখছেন।
তারা বলছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের মূল নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সংলাপ নাকচ করে দেওয়া হয়নি। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুই নেতা ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দুই মন্ত্রী দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এক সপ্তাহের টার্গেটে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের চলমান আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যর্থ হলে সংলাপের পথে যাবে সরকার। রাজনীতি ও আলোচনা দু’টি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আলোচনার সম্ভাবনা একেবারেই নাকচ করে দেওয়া যায় না।’
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, ‘সংলাপ-আলোচনা, এ নিয়ে এখনই কিছু বলা যাবে না। এখন এ নিয়ে বলার সময় আসেনি।’
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘সংলাপ চাইলে বিএনপিকে রাজনীতি করতে হবে, নাশকতা নয়।’
ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মুখ থেকে সভা-সমাবেশে সরকার দলের পক্ষ থেকে একটি অংশ সংলাপের কথা নাকচ করে আসলেও সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন অপর অংশ।
এ প্রসঙ্গে আলাপকালে শীর্ষ দুই মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের দুই নেতা পৃথকভাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমাদের ব্যক্তিগত ধারণা আলোচনা হবে। ওই দুই নেতা আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হোসেন তৌফিক (এইচ টি) ইমাম একটি অনুষ্ঠানে শর্তের ভেতর দিয়ে সংলাপের কথা বলেছেন। এটা ইঙ্গিতপূর্ণ।’
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘১২ জানুয়ারির জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আলোচনার ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দেননি। সুতরাং সংলাপ বা আলোচনার সম্ভাবনা নেই, এটা বলা যাবে না।’
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ওই নেতাদের অভিমত, এ পর্যায়ে সরকারকে সংলাপের পথে নিতে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের চলমান আন্দোলন এবং কূটনীতিক তৎপরতার সফলতার ওপর নির্ভর করছে।
জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করলে সমঝোতা হবে : শেখ হাসিনা
নির্বাচনোত্তর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপ সমঝোতার প্রশ্নের মুখোমুখি হলেও খোলাসা করেননি। তিনি ওই সময় বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে সহিংসতা-সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে এলে সমঝোতা হবে। সমঝোতা হলে নতুন নির্বাচন হবে।’
নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর গণভবনে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের পরও আলোচনা চলবে এবং সমঝোতা হলে প্রয়োজনে দশম সংসদ ভেঙে নির্বাচন দেওয়া হবে। তবে শর্ত হিসেবে তৎকালীন সময়ের আন্দোলন অর্থাৎ মানুষ হত্যা ও জ্বালাও-পোড়াও বন্ধের কথাও বলেন তিনি।
লিখিত মুচলেকা দিলে সংলাপ : এইচ টি ইমাম
সংলাপের শর্ত হিসেবে বিএনপির কাছ থেকে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়ার লিখিত মুচলেকা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। গত মঙ্গলবার তিনি এ প্রস্তাব দেন।
‘বিএনপির সঙ্গে আলোচনা বা সংলাপ নয়। আগে তাদের লিখিত দিতে হবে, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই, তবেই তাদের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে’ বলেন প্রধানমন্ত্রীর এ উপদেষ্টা।
নাশকতা ছাড়লে সংলাপ : হানিফ
আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘বিএনপি নিজেরাই নিজেদের নেতাদের ওপর হামলা চালিয়ে বিদেশীদের সহানুভূতি নিতে চায়। এর প্রমাণ হল— বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানের ওপর হামলা।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি অবরোধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করলে সংলাপের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। শুধু বিএনপি নয়, সব দলের সঙ্গে আলোচনা হবে।’
মনে হয় আলোচনায় বসতেই হবে : এরশাদ
রাজধানীর কাকরাইলে শনিবার বিকেলে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে তার বিশেষ দূত ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, ‘আমি ১ জানুয়ারি সমাবেশে আশঙ্কা করে বলেছিলাম, দেশে আবারও জ্বালাও-পোড়াও শুরু হবে। সব রাজনৈতিক দলগুলোকে ডাকুন। তিনি আমার কথা শুনলেন না। শেষ পর্যন্ত মনে হয় আলোচনায় বসতেই হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি শান্তির ডাক দিয়েছি। আসুন এ আন্দোলনকে বেগবান করি। জাতীয় কনভেনশন করি। কী করলে শান্তি আনা যায় সেই পথ বের করি।’
সংলাপের ব্যবস্থা করুন : বিএনপি
বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক আব্দুল লতিফ জনি স্বাক্ষরিত শুক্রবারের এক বিবৃতিতে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব এ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘বিএনপি প্রতিহিংসার রাজনীতি করে না। ক্ষমতায় গেলে কারো প্রতি প্রতিহিংসামূলক আচরণ করবে না। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আমরা বদ্ধপরিকর। জনগণের ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়া ও একটি অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্যই আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে লাগাতার আন্দোলনরত আছি।’
তিনি বলেন, ‘এই অবৈধ সরকার এখন খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। আবারও আহ্বান জানাচ্ছি, একটি অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে এই মুহূর্তে কার্যকর সংলাপের ব্যবস্থা করুন। উৎপীড়ন, পরিকল্পিত নাশকতা, প্রকাশ্য গুলি করে অবরোধকারীদের হত্যা আর ধরপাকড়ের পথ থেকে সরে আসুন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি দিন। যতক্ষণ পর্যন্ত না বিজয় অর্জিত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত চলমান অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।’
সংলাপ না হলে দেশে ভয়াবহ সংঘাত : বি চৌধুরী
দেশের বতর্মান রাজনৈতিক অবস্থা সবার জন্য অশনি সংকেত বলে মন্তব্য করেছেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। দ্রুত সংলাপের মাধ্যমে দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সংলাপ না হলে দেশ ভয়াবহ সংঘাতের দিকে যাবে। তবে বিদেশীদের চাপে যদি সংলাপ হয় তা হবে দেশের জন্য লজ্জাজনক।’
রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে চিকিৎসাধীন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানকে দেখে ফেরার সময় সাংবাদিকদের কাছে তিনি এ মন্তব্য করেন।
সংলাপের দাবিতে ৬ দলের বিবৃতি
চলমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণ ও বিরাজমান পরিস্থিতি সমাধানে সকল বিরোধী দলের সঙ্গে দ্রুত জাতীয় সংলাপ দাবি করেছে ২০ দলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত ছয় দলের মহাসচিবরা।
শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক যৌথ বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন ২০ দলীয় জোটের শরিক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া।
বিবৃতি প্রদানকারী দলগুলো হল- ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশ লেবার পার্টি।
বিবৃতিতে বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ঘোষিত সাত দফার ভিত্তিতে দেশের সকল বিরোধী দলের সঙ্গে দ্রুত জাতীয় সংলাপের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়।
ছয় দলের মহাসচিব বলেন, ‘সরকারের একগুয়েমী নীতির কারণেই আজকে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী দলকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ রাখা, বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার, বিরোধী দলের নেতার উপদেষ্টাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি, সরকারি দলের নেতাদের অশোভন আচরণ ও হুমকিপূর্ণ বক্তব্য চলমান সঙ্কটকে আরও জটিল করে তুলছে।’
তারা বলেন, ‘দেশে আজ যে রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য দায়ী সরকারের আত্ম-অহঙ্কার ও একগুয়েমী নীতি। সরকার চলমান সঙ্কটকে আমলে না নিয়ে ও বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকলে সঙ্কট আরও বেশী জটিল আকার ধারণ করতে পারে। যার কারণে জনগণের কষ্টার্জিত গণতন্ত্র চরম হুমকির মুখে পড়তে পারে।’