বিএনপির তিন শীর্ষ নেতা ‘আসল’ বিএনপির সঙ্গে!
আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি নতুন চমক নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে হাজির হবেন আসল বিএনপির মুখপাত্র দাবিদার কামরুল হাসান নাসিম। তিনি দাবি করেন, বিএনপির তিন শীর্ষ নেতা তার সঙ্গে রয়েছেন। কিন্তু তাদের নাম জানাতে অস্বীকার করেছেন।
নাসিম বলেন, ‘খালেদা জিয়া যদি ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমার দাবি মেনে না নেন, তাহলে ৬ ফেব্রুয়ারি আমি জাতির সামনে চমক দেখাব। সেদিন আমার সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির কমপক্ষে তিনজন সিনিয়র নেতা (স্থায়ী কমিটির সদস্য) উপস্থিত থাকবেন।
রবিবার সন্ধ্যার পর এ প্রতিবেদকের সঙ্গে মুঠোফোনে দীর্ঘসময় আলাপকালে তিনি এ সব কথা বলেন।
এ সময় নাসিম দাবি করেন, ‘বিএনপিকে জিয়াউর রহমানের আদর্শে ফেরাতে তিনি যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তাতে অনেকেই সন্দেহ করে থাকে আমার সঙ্গে সরকার বা সরকারের একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার যোগাযোগ রয়েছে। রয়েছে তাদের সাহায্য সহযোগিতা। কিন্তু এ ধারণা ভুল। কারণ অতীতে হাসিনা-খালেদার বিরুদ্ধে আক্রমণ করে কথা বলাতে ওই গোয়েন্দা সংস্থা আমাকে ইলেক্ট্রিক শকও দিয়েছে। করেছে নির্যাতন। তাই তাদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রশ্নই আসে না।’
বিএনপিকে বাঁচাতে একজন ওষুধ ওয়ালার ভূমিকা পালন করছেন দাবি করে নাসিম বলেন, ‘এই উদ্ধার অভিযানে নামার পর খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুগত মুষ্টিমেয় কিছু চামচা আমাকে যেমন হুমকি দিয়েছে, তেমনি দেশের গণমাধ্যমও আমাকে বাঁশ দিয়ে যাচ্ছে। তিনি সংবাদপত্রের কাছে সুস্থ সমালোচনা প্রত্যাশা করেন।’
বিএনপিকে গণতান্ত্রিক দলে পরিণত করতে ও খালেদা জিয়া-তারেক রহমানমুক্ত করতে দলের সিনিয়র, মধ্যম ও সাধারণ পর্যায়ের অনেক নেতাই নাসিমের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছে দাবি করে বলেন, ‘আমার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের দেড় থেকে দুই কোটি সমর্থক রয়েছে। আমার কর্মকাণ্ড বিএনপির জন্য অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ।’
নাসিম বলেন, ‘বিএনপির ক্রান্তিকালীন মুখপাত্র দাবি করার পর আমাকে খালেদা ও তারেকের ১০৯জন অনুসারী হত্যার হুমকি দিয়েছেন। আজকে (রবিবার) এ হুমকি একটু কমেছে। যদি আরও হুমকি দেওয়া হয়, তাহলে আমি খালেদা ও তারেকের নামে জিডি করব। আমি বিনা চ্যালেঞ্জে খালেদা ও তারেককে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নই। তাদের চ্যালেঞ্জ করার সামর্থ্য আমার আছে।’
শহীদ জিয়ার পরিবার খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ইমেজের কাছে আপনার ইমেজ দিয়ে বিএনপির মত একটি বৃহৎ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলকে কতটুকু টেনে নিতে পারবেন, আপনি কতটুকু আত্মবিশ্বাসী দ্য রিপোর্টের এমন প্রশ্নের উত্তরে নাসিম বলেন, ‘ধরুন আমার জন্ম পতিতালয়ে। আমার ব্যক্তি ইমেজ খুব ভাল না। আমি তো বিএনপির চেয়ারম্যান হতে চাইছি না। আমি চাইছি বিএনপিকে রক্ষা করতে। অনেক খ্যাতিমান চিকিৎসক দেশের বাইরে যেমন চলে যান, আবার অনেকে আছেন গ্রামে চলে যান দেশের সাধারণ মানুষকে সেবা করতে। আমি তেমনি একজন ওষুধওয়ালার ভূমিকা পালন করতে চাইছি। তাই এখানে আমার ইমেজ বড় কোনো বিষয় নয়।’
নাসিম জানান, ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে খালেদা জিয়া পদত্যাগ না করলে আমি নেতাকর্মীদের কলম হাতে নিয়ে তার পদত্যাগের দাবি নিয়ে যাব। আমার কর্মকাণ্ড সুস্থ ধারার। এখানে বিভ্রান্তির কিছু নেই।
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল হচ্ছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। কিন্তু বর্তমানে হাসিনা-খালেদা এ দল দুটিকে নিজেদের সম্পদ বানিয়ে ফেলেছে। যারা তাদের সঙ্গে রয়েছে, দল ক্ষমতায় গেলে কিছু পায়। একই সঙ্গে তাদেরকেও দিতে হয়। এখানে তারা ছাড়া বাকি যে নেতা রয়েছে, তারা মূলত তাদের চাকরি করে। তাদের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে এ জন্য তারা প্রতিবাদ করতে পারে না। দাঁড়াতে পারে না। কারণ তারা ভয় পায়, তাহলে তাদের চাকরি চলে যাবে।’
নাসিম জানান, আমি যশোর-২ আসনে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলাম। সে সময় প্রার্থীদের উপার্জিত টাকা কিভাবে খরচ করতে হয় তা দেখেছি। এ সব থেকে বিএনপিকে বের করে আনতেই আমি বিএনপিকে খালেদা-তারেক মুক্ত করতে চেয়েছি।’
দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপির পাশাপাশি সাধারণ মানুষ যখন ব্যতিব্যস্ত সময় পাড় করছে, ঠিক তখনই রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মুখপাত্রর দেখা মিলেছে। সেই মুখপাত্র আবার যেই সেই নয়, একেবারে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল(বিএনপি)‘র মুখপাত্র হিসেবে নিজেকে দাবি করেছেন। আর এ দাবির পক্ষে সম্প্রতি ইতোমধ্যেই তিনি রাজধানীর অভিজাত দুটি হোটেলে লাখ লাখ টাকা খরচ করে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। এ সব সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে যিনি জিয়াউর রহমানের অবর্তমানে দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন, ইতোমধ্যে তিনি দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রীর পদও অলংকৃত করেছেন সেই খালেদা জিয়াকে বিএনপি থেকে সরে যাওয়ারও আল্টিমেটাম দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ইতোমধ্যেই দলে নিজের নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সেই তারেক রহমানকেও বিএনপি ছাড়ার সময়সীমা বেধে দিয়েছেন। আগামী ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মা-ছেলে বিএনপি থেকে বের হয়ে না গেলে নাসিম তাদের দল থেকে বের করে দেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন।
নাসিমের এ সব ঘোষণা ও কর্মকাণ্ড বিএনপি বা দেশের আমুদে জনগণ আমলে না নিলেও তিনি বসে নেই। শীঘ্রই তিনি আবার গণমাধ্যমের সামনে হাজির হবেন বলে জানিয়েছেন।
নাসিম পরিচিতি : পুরো নাম কামরুল হাসান নাসিম। কখনো সাংবাদিক, কখনো ব্যবসায়ী নেতা আবার কখনও রাজনীতিক তিনি। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব দেশের বর্ষীয়ান রাজনীতিক কে এম ওবায়েদুর রহমানের স্ত্রী শাহেদা ওবায়েদের গড়া ‘গড়বো বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে আলোচনায় আসেন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘গড়বো বাংলাদেশ বিপ্লবী সংগঠন’ সংবাদ সম্মেলন করে দুই নেত্রীর অবসর দাবি করে। সে বছর ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই তাদের অবসরের আলটিমেটাম দেওয়া হয়। শাহেদা ওবায়েদ এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা হলেও নাসিম নিজেকে এর প্রতিষ্ঠাতা মুখপাত্র দাবি করেন।
২০১৫ সালে এসে ‘আসল বিএনপি’র দাবিদার হলেন কামরুল হাসান নাসিম। এর আগে গড়ব বাংলাদেশের ব্যানারে দুই নেত্রীর অবসর দাবি করলেও এখন সেই অবস্থান থেকে সরে এসে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পদত্যাগ চেয়ে বসেছেন। বর্তমানে তার মতামত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোটামুটি সঠিক পথেই আছেন।
গত শুক্রবার রাজধানীর অভিজাত হোটেল ওয়েস্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনে আগামী ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে খালেদা জিয়াকে পদত্যাগ করে সব কমিটি ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন কথিত ‘আসল বিএনপি’র এ মুখপাত্র।
নাসিম নিজেকে কৃষকদলের কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন দাবি করলেও সংগঠনটি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, কামরুল হাসান নাসিম নামে কোনো ব্যক্তি কৃষকদলের কোনো পদে অতীতেও ছিল না, এখনও নেই। বিবৃতিতে কৃষকদল অভিযোগ করে, ‘বিকারগ্রস্ত ওই ব্যক্তি সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তথাকথিত সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে।’
অবশ্য, নাসিমের দাবি, কৃষকদল মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছে। তার দেওয়া আসবাবপত্র এখনও কৃষকদলের কার্যালয়ে আছে। তার দাবি, তিনি জাতীয়তাবাদী ব্যবসায়ী ফোরামেরও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
এর আগে গত ৯ জানুয়ারি গুলশানের আরেকটি অভিজাত হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে তিনি ‘আসল বিএনপি’ গড়ার ঘোষণা দেন। নিজেকে ‘আসল বিএনপি’ দাবি করার পর আবারও আলোচনা আসেন কামরুল হাসান নাসিম।
জননেতা ডটকম নামে একটি অনলাইন নিউজপোর্টালের এডিটর ইন চিফ তিনি। সেই সুবাদে নিজেকে সাংবাদিক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক পরিচয় দেন। এর আগে ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর পল্টন ময়দানে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয় গড়ব বাংলাদেশ। এ নিয়ে সারা ঢাকা রঙিন পোস্টারে ছেয়ে ফেলা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত অবশ্য সমাবেশ হয়নি।
‘গড়বো বাংলাদেশ’ নিয়ে শাহেদা ও নাসিম কিছুদিন দেশের গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক সরব হয়েছিলেন। তারা রাজনীতি থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ‘মাইনাস’ দাবিতে বিভিন্ন সভা, সেমিনার, প্রেস ব্রিফিংও করেছেন। এ দাবিতে এ জুটি দেশে দিনভর হরতালও আহ্বান করেন। যদিও তাদের আহ্বানে জনগণকে সাড়া দিতে দেখা যায়নি।
কামরুল হাসান নাসিমের গ্রামের বাড়ি যশোরে। এক সময় খালেদা জিয়ার ভাই সাঈদ এস্কান্দারের মালিকানাধীন ইসলামিক টিভির ‘লাল সবুজের বাংলাদেশ’ টক শো অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন। এর আগে এস টিভির ‘জনস্বার্থে জননেতা’ অনুষ্ঠানেরও সঞ্চালক ছিলেন তিনি। কিছুদিন তিনি নাঈমুল ইসলাম খান সম্পাদিত ‘আমাদের অর্থনীতি’ পত্রিকার কার্যালয়ে গিয়ে বসতেন। সেখানে তাকে নিয়মিত ফেসবুকিং, ইমেইল চালাচালি নিয়েই ব্যস্ত থাকতে দেখা যেত বলে পত্রিকাটিতে কর্মরত কয়েকজন সংবাদকর্মী জানান। যশোরে জন্ম হলেও তিনি ঢাকাতেই আছেন দীর্ঘদিন। চুয়াডাঙ্গা ভি জে সরকারি হাইস্কুলে তিনি পড়াশোনা করেছেন।