‘সরকারের আতঙ্কে’ রাজধানীবাসীর ভোগান্তি
সরকার ও বিরোধী দলের ‘অবরোধে’ নাজেহাল ঢাকাবাসী। নতুন বছর শুরুর চতুর্থ ও পঞ্চম দিন সরকারি দলের অবরোধে পড়ে রাজধানী। এরপর থেকে টানা অবরোধ চলছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের। এর মধ্যে হরতালসহ বিশ্ব ইজতেমার দুই পর্বের শেষ দুই দিনে পুলিশের কঠোরতায় সেই ভোগান্তি আরও বেড়েছে। অনেকেই পুলিশের এই অবস্থানকে ‘সরকারের আতঙ্ক’ বলে অভিহিত করছেন।
বিশ্ব ইজতেমা শেষে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়ে সরকারকে জামায়াত-শিবির বিব্রতকর অবস্থায় ফেলাসহ দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করার প্রচেষ্টা চালাতে পারে- গোয়েন্দাদের এমন আশঙ্কা থেকেই সব ধরনের দোকানপাট সরকার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ইজতেমাকে কেন্দ্র করে নিষিদ্ধঘোষিত হিযবুত তাহরীর, জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনগুলো অপতৎপরতার মাধ্যমে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে পারে।
বিশ্ব ইজতেমার প্রথম ও দ্বিতীয় দফার শেষ দিন ছিল যথাক্রমে ১১ ও ১৮ জানুয়ারি। এই দুই দিনেই সরকার সতর্কতাস্বরূপ অবরুদ্ধ ঢাকার মধ্যেও নতুন অবরোধ আরোপ করে। বিশেষ করে রবিবারের ঢাকা ছিল রাস্তার পিঠাবিক্রেতা থেকে শুরু করে দামি রেস্তোরার জন্য বাধ্যতামূলক বন্ধের দিন।
এর কারণ জানতে চাইলে ফুটপাতের দোকানদাররা পুলিশের নিষেধাজ্ঞার কথা জানালেও পুলিশ বিষয়টি স্বীকার করেনি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দোকান বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে- এমন কোনো তথ্য আমার জানা নেই। এরপরও বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখছি।’
তেজগাঁও জোনের ডিসি বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ‘ফুটপাতে অবৈধ দোকান তুলে দেওয়া হচ্ছে। কোনো ব্যক্তিমালিকানা দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। ফুটপাতের দোকান উচ্ছেদ নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ।’
মিরপুর জোনের ডিসি নিসারুল আরিফ বলেন, ‘দোকান বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে- এমন কোনো তথ্য আমি জানি না।’
গুলশান-বনানীতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
রবিবার সকাল থেকেই পুরো গুলশান এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলে পুলিশ। গুলশান ও বারিধারার আবাসিক ও কূটনৈতিক পাড়ার সব প্রবেশ মুখে পুলিশি পাহারা বসানো হয়। বারিধারা ডিওএইচএস, বনানী, হাতিরঝিল, গুলশান শুটিংক্লাবের সামনে, নতুনবাজার, নর্দা-কালাচাঁদপুর, মহাখালী এলাকা থেকে গুলশান এলাকার প্রবেশ মুখসহ গুলশানে ঢোকার সব পথে মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা, রিকশা, রিকশাভ্যান ও কাভার্ডভ্যানের প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়।
ওই সব এলাকার আবাসিক বাসিন্দারা তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছেন তবে সেগুলো বিভিন্ন চেকপোস্টে পুলিশি তল্লাশির মুখে পড়ে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি নিরাপত্তার কারণে সাধারণ মানুষকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। গুলশান এলাকায় কর্মরত কোনো মোটরসাইকেলারোহীকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। অনেককে বিনীত অনুরোধ করতে দেখা গেলেও পুলিশ নিজেদের অপারগতার কথা তাদের জানিয়ে দেন।
বনানীর একটি বহুজাতিক ফার্মে কাজ করেন ফনি ভূষণ সরকার। জানতে চাইলে তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এমনিতেই তো অস্বাভাবিক অবস্থ চলছে। এর মধ্যে আজ (রবিবার) আরও অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। কি যে হয়!’
গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার নূরুল আলম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘রবিবার এই এলাকায় সাপ্তাহিক বন্ধের দিন। এ ছাড়া এটি ভিআইপি এলাকা হওয়ায় বিশেষ কিছু কারণে সকালের দিকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে।’
দৈনিক বাংলা থেকে ইত্তেফাক মোড়
নাশকতার আশঙ্কায় রবিবার সকাল থেকে মতিঝিল এলাকার ফুটপাতের সকল দোকানপাট বন্ধ করে দেয় পুলিশ। এতে বিপাকে পড়েন সাধারণ কর্মজীবী মানুষ। পাশাপাশি স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ীদের লোকসান গুণতে হয়।
মতিঝিলের দিলকুশা, দৈনিক বাংলা, ইত্তেফাক মোড়, আদমজী কোর্ট ও শাপলা চত্বরের আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শুধু ফুটপাতের দোকান নয়, খাবার হোটেলগুলোও বন্ধ রাখা হয়েছে। পুলিশি বাধায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে না পেরে ব্যবসায়ীদের আফসোস করতে দেখা গেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের ব্যবসায়ী বাবুল মিয়া বলেন, ‘সকাল বেলা দোকান খুলতে আসলে পুলিশ বাধা দেয়। কেন জানতে চাইলে বলেছে, আজ গ্যাঞ্জাম হতে পারে। এ কারণে বন্ধ করতে হবে।’
জানতে চাইলে মতিঝিল থানার পেট্রোল ইন্সপেক্টর (পিআই) শেখ আবুল বাসার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ প্রশাসন বদ্ধপরিকর। এরই ধারাবাহিকতায় রবিবার অতিরিক্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফুটপাতের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’
হঠাৎ করে দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েন সাধারণ মানুষ। ওয়ান ব্যাংকের দিলকুশা শাখার কর্মকর্তা শেখ মামুন বলেন, ‘সকালে নাস্তা করতে এসে দেখি দোকান বন্ধ। শুধু এখানে না, পুরো মতিঝিলেই সব দোকান বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ।’
বায়তুল মোকাররমের সামনে গণআটক
শনিবারের পুলিশি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রবিবার সকালে পল্টন মোড় থেকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পর্যন্ত ফুটপাতের দোকান খোলেন নিম্ন আয়ের মানুষ। দোকান খোলার অপরাধে প্রায় ৩০ জনকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। সরেজমিন এ দৃশ্য দেখা যায় জাতীয় মসজিদের সামনে। কয়েক দোকানিকে নিজেদের সাজানো পসরা ফেলে পালাতেও দেখা যায়।
পুরান ঢাকায় নতুন রূপ
রাজধানীর পুরান ঢাকার নয়াবাজার, রায়েরসাহেব বাজার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, লহ্মীবাজার, সূত্রাপুর ও বাবুবাজারসহ প্রায় সব এলাকার ফুটপাতের দোকানসহ প্রায় সব দোকানই বন্ধ দেখা যায়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফয়সাল আহমদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এর আগের অবরোধে কখনও এমন পরিস্থিতি দেখিনি। যেন পুরান ঢাকার নতুন রূপ! সরকার নিজেই মনে হয় আতঙ্কতি।’
ফাঁকা মিরপুর
রাজধানীর অধিকাংশ মানুষের বাস এখন মিরপুরে। রবিবার মিরপুরের আগারগাঁও, শেওড়াপাড়া, দশ নম্বর গোলচত্বর থেকে এক নম্বর ও ১২ নম্বর পর্যন্ত ফুটপাতের সকল দোকানপাঠ বন্ধ দেখা গেছে। সীমিত আকারে কিছু দোকান খোলা থাকলেও রাস্তায় যানবাহনের উপস্থিতি ছিল খুবই কম।
মিরপুরের শেওড়া পাড়া থেকে শেরেবাংলা নগরের অফিসে যেতে গিয়ে রবিবার সকালে যানবাহনের সঙ্কটে পড়েন মজিদা আক্তার। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘শত হরতালেও মিরপুরে গাড়ি পাওয়া যায়। কিন্তু আজ পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। আমাদের নিজস্ব তো গাড়ি নেই, ভোগান্তি দেখারও কেউ নেই।’