নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলে নির্দেশনা ‘মানেনি’ সোনালী ব্যাংক
সোনালী ব্যাংকে ৪৩৫টি সিনিয়র অফিসার, ৫৪৫টি অফিসার এবং ৭২৫টি অফিসার (ক্যাশ) পদে নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার ফল গত বুধবার (১৪ জানুয়ারি) প্রকাশিত হয়। এ পরীক্ষার অন্যতম নির্দেশনা ছিল, প্রশ্নের ক্রমানুসারে উত্তর লিখতে হবে এবং যারা নির্দেশনা ভঙ্গ করবে তাদের উত্তরপত্র সরাসরি বাতিল বলে গণ্য হবে। কিন্তু ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রে যারা প্রশ্নের ক্রমানুসারে উত্তর দেননি এমন একাধিক পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
উত্তীর্ণ না হওয়া একাধিক পরীক্ষার্থীর অভিযোগ, প্রকাশিত ফল দেখে মনে হয়েছে উত্তরপত্র সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয়নি।
এ ছাড়াও বিসিএসের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় এবং অন্যান্য সরকারি চাকরির লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, বিভিন্ন সরকারি পদে চাকরি করছেন— এমন একাধিক পরীক্ষার্থীও উত্তীর্ণ হতে পারেননি সোনালী ব্যাংকের এ পরীক্ষায়।
সোনালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার পদের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন রফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘আমি এর আগে পূবালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদের জন্য মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছি। (নিয়োগ পাননি তিনি এ সব ব্যাংকে)। ৩৩তম বিসিএস এ নন-ক্যাডার পদেও টিকেছি। ৩৪তম বিসিএসে মৌখিক পরীক্ষা দেব। কিছুদিন পরে রাজউকে সহকারী পরিচালক পদে মৌখিক পরীক্ষা দেব।’
তিনি বলেন, ‘মৌখিক পরীক্ষার পরে চাকরি না হোক তাতে কিছুই যায় আসে না। কিন্তু ক্রমানুসারে উত্তর লিখে এবং ভাল পরীক্ষা দেওয়ার পরেও সোনালী ব্যাংকের এ পরীক্ষায় আমি টিকতেই পারলাম না। বিষয়টি মেনে নিতে পারছি না। আমার বিশ্বাস ছিল ৫০০ পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হলেও সে তালিকায় আমি থাকব।’
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘রেজাল্ট দেখে মনে হচ্ছে, ৫০০ জনকে হয়ত ফেয়ারলি নেওয়া হয়েছে। বাকি উত্তীর্ণদের তালিকা অনিয়মের মাধ্যমে করা হয়েছে।’
বর্তমানে সহকারী পরিবার পরিকল্পনা পদে চাকরিরত রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আগে আমরা বিভিন্ন পরীক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতি দেখেছি। কিন্তু এবার সোনালী ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষায় যে ডাকাতি হয়েছে তা পরিকল্পিতভাবেই করা হয়েছে।’
আরেক পরীক্ষার্থী খালেদ মোশাররফ দিপু বলেন, ‘আমার মুক্তিযোদ্ধা কোটা আছে। তা ছাড়া পরীক্ষাও ভাল হয়েছিল। বিশ্বাস ছিল, আমি ২০ জনের মধ্যেই থাকব। আমি এর আগে ৩৩তম এবং ৩৪তম দুটি বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। সবমিলিয়ে চিন্তা করতে পারিনি যে, সোনালী ব্যাংকের এ পরীক্ষায় আমি টিকব না।’
ছাত্রলীগের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উপ-ক্রীড়া সম্পাদক পদধারী এ পরীক্ষার্থী বলেন, ‘সাধারণত যারা কোনো চাকরির পরীক্ষাতে টিকতে পারবে না ভাবে তারাই নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়ে থাকে। আমার এক বন্ধুর স্ত্রী সর্বশেষ নিবন্ধন পরীক্ষাতে টেকেনি অথচ সোনালী ব্যাংকের এ পরীক্ষায় টিকেছে। এটা কী করে সম্ভব?’
কাজী দিলশাদ হাসান সাগর (ফেসবুক এ্যাকাউন্ট Kazi Dilshad Hasan Sagor) Bank : Our Goal নামক ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘সিরিয়াল ব্রেক করে যদি পাস করা যায় তাহলে সোনালী ব্যাংকের নাটককে কী বলবেন? একটু ফেয়ারলি ভেবে দেখেন। আমার পাশের দুইজন টিকেছে যারা লিখিত পরীক্ষার আগেই সাত লাখ করে টাকা দিয়ে রেখেছিল। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ফেয়ার রেজাল্ট হয়েছে। কিন্তু ওই দুজনের পাস করার কথা শুনে নিজের ধারণাটাকে রেসপেক্ট করতে পারলাম না।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমি প্রথমে মেনে নিয়েছিলাম যে, আমার এক্সাম হয়ত ভালো হয়নি, তাই টিকিনি। কিন্তু এখন মানতে খুব কষ্ট লাগছে।’
মো. আল আমিন (ফেসবুক এ্যাকাউন্ট Md Al Amin) একই পেজে লিখেছেন, ‘পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের ক্রমানুসারে লেখার নির্দেশ ছিল কিন্তু ফলাফলের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি কেন? এই প্রশ্নটাই যথেষ্ট। যেমন এ রোল নং ৫৫৩৮৪১, প্রশ্নের ক্রমানুসারে লেখেনি কিন্তু পাস করেছে।’
এদিকে এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল কিন্তু পাস করেনি এমন একজন দ্য রিপোর্টকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি জানি সাইফুল এবং রূপম নামের দু’জন সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিল। তারা টিকেছে কিন্তু পরীক্ষার উত্তরপত্রের সিরিয়াল মেইনটেইন করেনি।’
সিরিয়াল মেইনটেইন করেছেন কিনা, জানতে চাইলে রূপম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমি দুঃখিত। এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কোনোভাবেই সাহায্য করতে পারব না।’
সিরিয়াল মেইনটেইন করেছেন কিনা, জানতে চাইলে সাইফুল প্রথমে বলেন, ‘আপনি এক মিনিট পরে ফোন দিন। এরপরে একাধিকবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি আর ফোন ধরেননি।’
তৌহিদ চৌধুরী (ফেসবুক এ্যাকাউন্ট Touhid Chowdhury) Bank : Our Goal নামক ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘অন্যের উদ্যোগের জন্যে অপেক্ষা না করে আসুন কাকলি বিদ্যালয়ের মতো বিদ্যালয়ে আবেদন করি বা ৩৪তম বিসিএস মতো আদালতে মামলা করি ও পাশাপাশি তাদের এই রকম নির্লজ্জ কাজের প্রতিবাদে আন্দোলন করি। তাদের এহেন খেলা মানব না। এটা কোথাকার নিয়ম? যা খুশি তাই করবে?’
দেবেন্দ্র বিধান (ফেসবুক এ্যাকাউন্ট Debendro Bidhan) একই পেজে লিখেছেন, ‘সোনালী ব্যাংকের ফলাফল নিয়ে কিছু স্যারের কাছে উত্তরপত্র পড়লে চাকরি নিশ্চিত আর কিছু স্যারের কাছে খাতা পড়লে পাসই করবেন না।’
নাম না প্রকাশের শর্তে একজন পরীক্ষার্থী দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘আমি শুনেছি ব্যাংকের এক কর্মকর্তার কাছ থেকে যে উচ্চপদস্থ কিছু কর্মকর্তারা নিজেদের নির্বাচিত প্রার্থী নিয়ে অবশিষ্ট অল্প কয়েকজনকে মেধার ভিত্তিতে টিকিয়েছেন। উত্তরপত্র আসলেই ভালভাবে মূল্যায়িত হয়নি।’
আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (ফেসবুক এ্যাকাউন্ট Abdullah Al Mahmud) Bank : Our Goal নামক ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘সোনালী ব্যাংকে অনেকেই সিরিয়ালি উত্তর না দিয়েও টিকেছে। যারা নিয়মমাফিক সিরিয়ালি লিখেও টিকে নাই, এটা তাদের প্রতি অবিচার। কারণ এটা কম্পিটিটিভ পরীক্ষা, এখানে যারা নিয়ম না মেনে (সিরিয়াল মেন্টেইন না করে) পরীক্ষা দিয়েছে তাদের প্রতি দয়া দেখিয়ে নিয়ম মানাদের প্রতি অবিচার করার কোনো সুযোগ নেই।’
এ ব্যাপারে রিট করলে রেজাল্ট বাতিল হয়ে যাবে এবং খাতা পুনর্মূল্যায়ন হতে পারে বলে সোনালী ব্যাংকের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা (DGM) জানিয়েছেন বলেও আব্দুল্লাহ আল মামুন তার পোস্টে উল্লেখ করেছেন।
সোনালী ব্যাংকের এই তিনটি পদে পরীক্ষা দিয়েছেন এমন ২০ জনের বেশী পরীক্ষার্থী দ্য রিপোর্টকে জানিয়েছেন, তারা খুব শিগগিরই হাইকোর্টে ব্যাংকের বিরুদ্ধে রিট করবেন।
সোনালী ব্যাংকের প্রধান শাখার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি দীর্ঘকাল এ ব্যাংকে চাকরি করছি। আগের নিয়োগ পরীক্ষাগুলোতে কিছুটা এদিক-ওদিক হলেও এবার যেমনটা হয়েছে আগে ততটা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘যাদের জিজ্ঞেস করছি সেই বলছে, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। ব্যাংকের জুনিয়র কর্মকর্তা যারা সিনিয়র পদের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিল, এমনকি মুক্তিযোদ্ধা কোটা আছে, তাদের কাউকেই এখনো উত্তীর্ণ হতে শুনিনি।’
সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ এইচ এম হাবিবুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে এখন আবার বলার কী আছে? এ সব তো অনেক দিন আগের কথা। ফলাফল বোধহয় কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে।’ সব ঝামেলা মিটিয়েই ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।
সিরিয়ালের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে ম্যানেজিং ডিরেক্টর ভাল বলতে পারবেন।’
সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রদীপ কুমার দত্তের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
সোনালী ব্যাংকের ৪৩৫টি সিনিয়র অফিসার, ৫৪৫টি অফিসার এবং ৭২৫টি অফিসার (ক্যাশ) পদের বিপরীতে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন সিনিয়র অফিসার পদে ১৫৭৮, অফিসার পদে ১৬৯৭ এবং অফিসার (ক্যাশ) পদে ২৫৫৫ জন।
এর আগে গত বছরের ২২ আগস্ট ব্যাংটিতের নিয়োগের জন্য এমসিকিউ পরীক্ষা নেওয়া হয়। এমসিকিউয়ের ফল প্রকাশিত হয় ২৭ আগস্ট। এতে সিনিয়র অফিসার পদে ৩২ হাজার ৬৮৮, অফিসার পদে ২৯ হাজার ১৮৪ এবং অফিসার (ক্যাশ) পদে ১৪ হাজার ৭৫৫ জন উত্তীর্ণ হন। এরপর লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১৩ সেপ্টেম্বর।
(সূত্র: দ্যা রিপোর্ট)