টাকার বিনিময়ে সংবর্ধনা, আটক ২
টাকার বিনিময়ে কৃতি শিক্ষার্থী ও গুণীজন সংবর্ধনা প্রদানের অনুষ্ঠান থেকে প্রথমে বাংলাদেশ শিক্ষা পর্যবেক্ষক সোসাইটির পরিচালক মো. তাজুল ইসলাম এবং পরবর্তীতে অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা সৈয়দা তাসলিমা লিমাকে আটক করেছে শাহবাগ থানা পুলিশ।
সোমবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে কেন্দ্রীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তন থেকে তাকে আটক করা হয়।
অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের প্রতারণার অভিযোগের ভিত্তিতে এই দুজনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখার পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া ৩২১ জন শিক্ষার্থীকে সংবর্ধনা প্রদানের এই অনুষ্ঠান বিকেল তিনটায় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে বলে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের আমন্ত্রণপত্রে জানানো হয়। আর সাংবাদিকদের জানানো হয় অনুষ্ঠান শুরু হবে বিকেল সাড়ে তিনটায়।
আমন্ত্রিতরা কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে উপস্থিত হলে তাদেরকে জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে নেওয়া হয় স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণ দেখিয়ে।
প্রায় দেড়ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও বিশেষ অতিথি অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব পীরজাদা শহিদুল হারুন, পরিচালক মো. তাজুল ইসলাম, জেনারেল সেক্রেটারি আবু জাফর রাজু ও উপস্থাপিকা সৈয়দা তাসলিমা লিমা ছাড়া অতিথি ও আয়োজকদের আর কেউই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হননি। তাছাড়া যে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে বলে টাকা নেওয়া হয়েছে অনুষ্ঠানে সে প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষকেরও দেখা মেলেনি। তাই শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ হয়ে শাহবাগ থানা পুলিশকে খবর দেয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত একাধিক শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক জানান, এই অনুষ্ঠানের প্রবেশপত্র নেওয়া বাবদ প্রতিটি শিক্ষার্থীর নিকট থেকে আড়াইশ টাকা নেওয়া হয়েছে।
কীভাবে নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে সুপ্রীম কোর্টের অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান নামের একজন অভিভাবক বলেন, ৬ষ্ঠ ও ৯ম শ্রেণির শ্রেণি শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে দুই পৃষ্ঠার একটি ফরম পূরণ করিয়ে আড়াই শত করে টাকা নিয়েছে। ফরমের একটি পৃষ্ঠা শ্রেণী শিক্ষক রেখে এই অনুষ্ঠানের প্রবেশপত্র হিসেবে আরেকটি পৃষ্ঠা শিক্ষার্থীদের নিকট দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের যে প্রবেশপত্র দেওয়া হয়েছে সেখানে শুধু শিক্ষার্থীদের স্বাক্ষর ছিলো। প্রতিষ্ঠান প্রধান, সমন্বয়ক ও কর্তৃপক্ষের কোনো স্বাক্ষর নেই। এসব কিছু মিলিয়ে সন্দেই হয়, আমাদের প্রতারিত করা হয়েছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন ভুয়া সংগঠন টাকার বিনিময়ে সংবর্ধনা দিয়ে থাকে। আমাদের মনে হয়েছে আমরা তাদেরই খপ্পরে পড়েছি।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হাজী আলমাস নামের এক অভিভাবক বলেন, আমরা বুঝতে পারছি না এরকম একটি সংগঠনের সঙ্গে স্বনামধন্য একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশ হলো কীভাবে।
অনুষ্ঠানে একাধিক শিক্ষার্থী নিশ্চিত করেছে যে বাংলাদেশ শিক্ষা পর্যবেক্ষক সোসাইটির পক্ষ থেকে সৈয়দা তাসলিমা লিমা এবং সুদীপ রায় বাপী শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে টাকা তোলার জন্য তাদের প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলেন।
এদিকে সোসাইটির প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া সোসাইটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাঁচটি মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে চারটি নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। একটি নম্বরে ফোন করা হলে রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি ফোন ধরেন। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, আমার এই সংগঠনের সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। পাশাপাশি জেলার হওয়ায় বাংলাদেশ শিক্ষা পর্যবেক্ষক সোসাইটির চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় ছিল। এর বেশি কিছুই নয়। আমি বুঝতে পারছি না সে আমার নাম কেন প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দিয়েছে। তিনি শরিফুল ইসলামসহ এই সোসাইটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের বিচারও দাবি করেছেন।
সংবর্ধনা নেওয়ার জন্য কেন টাকা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে ভিকারুন্নেসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর শ্রেণী শিক্ষক আবুল হোসেন আকাশ দ্য রিপোর্টকে বলেন, কেন নেওয়া হয়েছে এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।
নিজেকে জুনিয়র শিক্ষক দাবি করে তিনি বলেন, আমি অবশ্য এ ব্যাপারে একজন সিনিয়র আপাকে (সিনিয়র শিক্ষিকা) জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনিও কিছু বলতে পারেননি। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারবেন।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান অধ্যক্ষ মঞ্জুআরা বেগমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
অভিযুক্তদের শাহবাগ থানায় নিয়ে আসার পরে একজন অভিভাবক শাহবাগ থানায় এসে ইন্সপেক্টর (তদন্ত) এ কে সাইদুল হক ভূইয়ার নিকট বলেন, যাদেরকে ধরা হয়েছে তাদের দুজন অভিভাবক স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে দায়ী করছে। তিনি ওই দুজন অভিভাবকের ছবি সাইদুল ইসলামকে দেখিয়ে বলেন, তারা সকল অভিভাবককে আয়োজকদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছে। বাংলাদেশের যেকোনো অনুষ্ঠানেই কমবেশি কালক্ষেপণ হয়েই থাকে।
বাংলাদেশ শিক্ষা পর্যবেক্ষক সোসাইটিকে প্রতারণার যে অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে সে বিষয়ে তিনি বলেন, এই সংগঠনের পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সংবর্ধনা ও ক্রেস্ট প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করতে অনেক খরচ হয়। এসবের ন্যূনতম একটা খরচ আছে। তা বাবদই শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে।
শাহবাগ থানা থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, মো. তাজুল ইসলাম এবং সৈয়দা তাসলিমা লিমা এখন পর্যন্ত থানাতে অবস্থান করছে।
শাহবাগ থানা ওসি সিরাজুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, তাদের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত তারা থানাতেই থাকবে।
মো. আতাউর রহমান বলেন, শাহবাগ থানার ওসির সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখব। তাছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমেও ঘটনাটি প্রকাশিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি কোনো পদক্ষেপ না নেয় সোসাইটির বিরুদ্ধে এবং আমাদের টাকা ফেরত না দেয় তবে আমরা অ্যাকশনে যাব।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ শিক্ষা পর্যবেক্ষক সোসাইটির উদ্যোগে জাতীয় শিক্ষক দিবস উপলক্ষে ‘দেশ, জাতি ও সমাজ গড়ার মূল কারিগর শিক্ষক’ শীর্ষক আলোচনা সভা, কৃতি শিক্ষার্থী ও গুণীজন সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, বিশেষ অতিথি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, শিক্ষা সচিব মো. নজরুল ইসলাম খান, সংস্কৃতি বিষয়ক সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত এম শহীদুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত থাকবে বলে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছিল।