টানা অবরোধে পরিবহন খাতে ধস অবরোধের ১৪ দিনে ক্ষতি ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের লাগাতর অবরোধে দেশের পরিবহন খাতে বড় ধরনের ধস দেখা দিয়েছে বলে দাবি করেছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা। টানা ১৪ দিনের অবরোধে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন খাতে মোট ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি পরিবহন মালিকদের।
শুধু যাত্রী পরিবহন খাতে এক দিনের অবরোধে ক্ষতি হচ্ছে ৩০০ কোটি টাকা। ওই হিসাবে টানা ১৪ দিনের অবরোধে পরিবহন খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
অন্যদিকে পণ্য পরিবহন খাতে দৈনিক দুই শ’ কোটি টাকা ক্ষতি হিসাবে ১৪ দিনে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। আর রাজনৈতিক সহিংসতায় এ পর্যন্ত এক শ’ যানবাহনে অগ্নি সংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়েছে বলে দাবি বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে পরিবহন খাতের প্রায় ৫০ কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে।
হানিফ এন্টারপ্রাইজের আরামবাগ কাউন্টারে সোমবার সন্ধ্যায় যোগাযোগ করে জানা যায়, বিগত ১৪ দিনে এই কাউন্টার থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। আরামবাগ কাউন্টারের ম্যানেজার মো. আলিম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আরামবাগ কাউন্টার থেকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার রুটে এসি ভলভো বাস চলাচল করে। তবে টানা অবরোধে এই রুটে কোনো গাড়ি চলাচল করছে না।’
এ প্রসঙ্গে হানিফ এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক মো. তোফাজ্জল হোসেন রিপন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমাদের কোম্পানিতে এসি ও ননএসি মিলিয়ে সবসময় চার শ’ গাড়ি চলাচল করে। এর মধ্যে ২০টি ভলভো বাস চলাচল করে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার রুটে। অবরোধের শুরু থেকে আজ (সোমবার) পর্যন্ত আমাদের একটিও ভলভো গাড়ি ছাড়া হয়নি। দৈনিক হিসাবে শুধু ভলভো গাড়ি থেকেই কোম্পানির পাঁচ লাখ টাকা আয় হতো। যা এখন সম্পূর্ণই বন্ধ রয়েছে।’
রিপন বলেন, ‘এ ছাড়া দেশের সব অঞ্চলে ননএসি প্রায় ৩৮০টি বাস চলাচল করে। কিন্তু অবরোধে উত্তরবঙ্গের কোনো রুটে গাড়ি চলাচল করছে না। শুধু সিলেট, খুলনা ও বরিশাল রুটে ৫০টির মতো গাড়ি চলাচল করছে। ননএসি বাস থেকে আমাদের দৈনিক আয় ১৫ লাখ টাকা। অর্থ্যাৎ এসি-ননএসি মিলিয়ে আমাদের কোম্পানির আয় দৈনিক ২০ লাখ টাকা। অফিস স্টাফদের বেতন দিয়ে বর্তমানে কোম্পানির কোনো আয় নেই। বরং ঘাটতি রয়েছে।’
তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘প্রতিটি গাড়িতে চালক, হেলপার ও সুপার ভাইজার মিলে মোট তিনজন স্টাফ সরাসরি যুক্ত থাকেন। এই হিসাবে চার শ’ গাড়িতে সরাসরি ১ হাজার ২০০ জন স্টাফ যুক্ত। প্রকৃত পক্ষে এর সংখ্যা আরও বেশি। কারণ একটি গাড়ির জন্য মাত্র একজন চালক বা হেলপার থাকে না। গাড়ি প্রতি দুই জন করে থাকে। সব মিলিয়ে আমাদের প্রায় দুই হাজার স্টাফ বেকার রয়েছে যাদের দৈনিক ভিত্তিতে বেতন দেওয়া হয়। এক দিন গাড়ি বন্ধ থাকলে ওই গাড়ির এই তিন জন স্টাফের বেতনও বন্ধ থাকে।’
হানিফ পরিবহনের হিসাব মতে শুধু এই কোম্পানির দুই হাজারের অধিক পরিবহন শ্রমিক বেকার রয়েছে।
একই বিষয়ে শ্যামলী পরিবহনের হেড অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কোম্পানিটির কর্মকর্তা আনন্দ লাল দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘অবরোধের শুরু থেকে সারাদেশে আমাদের কোম্পানির বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। অবরোধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সার্ভিস বন্ধ থাকবে।’
সরকারের নির্দেশনা প্রসঙ্গে আনন্দ বলেন, ‘অনেকেই অনেক কথা বলেন। বাস্তবতা ভিন্ন। সরকার নিরাপত্তা দেবে এটা বলেই খালাস। বললেই কি নিরাপত্তা পাওয়া যায়। রিস্ক নিয়ে আমরা রাস্তায় বাস নামাতে চাই না।’
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে চলাচলকারী ঢাকা-রামগঞ্জ রুটের এশিয়া এক্সক্লুসিভ পরিবহনটিও অবরোধে বন্ধ রাখা হয়েছে, বন্ধ রয়েছে ঢাকা-লক্ষ্মীপুর-নোয়াখালী-রায়পুর রুটের ঢাকা এক্সপ্রেস দূরপাল্লার বাস কোম্পানিটির সকল বাস।
এশিয়া এক্সক্লুসিভের ম্যানেজার মনিরুজ্জামান ভূইয়া ভুট্টু দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘প্রতিটি অবরোধের মতো এবারের অবরোধেও আমাদের কোম্পানির সকল বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। অবরোধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোনো বাস ছাড়ছি না।’
এদিকে বাস মালিকদের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে না বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির দেওয়া তথ্যের। মালিকদের পক্ষ থেকে অধিকাংশ গাড়ি চলাচল বন্ধ দাবি করা হলেও সংগঠনটির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘টানা অবরোধে পরিবহন খাতের বড় ধরনের কোনো ধস এখনও নেমে আসেনি। অবরোধের প্রভাব রয়েছে তবে এতটা মারাত্মক না। দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহনে ৬০ ভাগ বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। কিন্তু পণ্য পরিবহনে প্রায় ৮০ ভাগ যানবহনই চলাচল করছে।’
এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের কাছে এ পর্যন্ত প্রায় ১০০টি গাড়িতে আগুন দেওয়া ও ভাঙচুরের তথ্য আছে। এতে প্রায় সম্পদের ক্ষতি হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। আর এক দিন গাড়ি বন্ধ থাকলে পরিবহন খাতে দৈনিক ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।’
এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আশাকরি সরকার খুব শিগগিরই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিবে। তখন আমরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারব।’
এদিকে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘টানা অবরোধে দেশের পণ্য পরিবহনের কাজে যে সব যানবহন ব্যবহার করা হয় তার প্রায় ৯০ শতাংশই বন্ধ রয়েছে। মাত্র ১০ শতাংশ গাড়ি চলাচল করছে তাও দূরপাল্লার না। প্রতিদিন ২০০ কোটি টাকা লোকসান হিসাব করলে পণ্য পরিবহন খাতে গত ১৪ দিনে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। বেকার রয়েছে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার শ্রমিক।’
তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘পণ্য পরিবহন খাতের অধিকাংশ গাড়িই ব্যাংক ঋণে কেনা হয়। বিআরটিএ ও আমাদের সমিতির হিসাবে সারাদেশে প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান পণ্য পরিবহনে জড়িত। একটি গাড়ি কিনতে ৬০ ভাগ ব্যাংক ঋণ নেওয়া হয়। গড়ে ৪০ লাখ টাকা একটি গাড়ির দাম হলে ১ লাখ ১২ হাজার ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানের পেছনে ব্যাংক ঋণ বোঝা রয়েছে ২৬ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। এভাবে হরতাল অবরোধ চলতে থাকলে পরিবহন ব্যবসায়িরা ক্লাসিফাইড (শ্রেণীকৃত) ঋণের তালিকায় চলে যাবে।’
তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘গতবছর ইলেকশনকে (নির্বাচন) কেন্দ্র করে টানা হরতালে চলেছে। তখন যে ক্ষতি আমাদের হয়েছে তা এখনও পুষিয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু এ বছর প্রথম থেকেই অবরোধ শুরু হওয়ায় আমাদের শেষ পর্যন্ত ব্যবসাগুটিয়ে বাসায় বসে থাকতে হবে। নতুন করে কেউ এই খাতে বিনিয়োগ করছে না। অনেকে গাড়ি বিক্রি করে যে ব্যবসা বন্ধ রাখবে তাও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ কেউ গাড়ি কিনতেও চাচ্ছে না। ফলে গাড়ি বসিয়ে রেখে ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে হচ্ছে।’