‘বিএনপি-জামায়াত নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব বিদেশীদের’
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ঢাকায় অবস্থান করা সবগুলো দেশ ও বৈশ্বিক বিভিন্ন জোটের চার্জ দ্য এফেয়ার্স, রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার এবং মিশন প্রধানদের ডেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী তিন দিনে (গত ১৪ জানুয়ারি থেকে) চার দফা বৈঠক করেছেন। এ সময় তিনি সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন। বৈঠকে বিদেশীরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রস্তাব দিয়েছে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীকে আইন করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক। যাতে গণতন্ত্র টেকসই হয়। এদের নিষিদ্ধ করা হলে সরকারের পাশে থাকবে বিদেশীরা।
বিদেশীদের সঙ্গে তিন দিনের চার দফা বৈঠক শেষে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী তার দফতরে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের ডেকে বৈঠকের ফলাফল জানান। এই সময়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম ও সচিব মো. শহীদুল হক উপস্থিত ছিলেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘গত কয়েকদিনের যে আলোচনা, এটা ছিল বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং দেশব্যাপী বিএনপি-জামায়াত জোট, যে কর্মকাণ্ড করে চলেছে, মূলত এটা সম্বন্ধে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে আমরা মতবিনিময় করেছি। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে এগুলো যেভাবে দেখি তা যেমন বলেছি, ঠিক তেমনি তাদের মতামতও জেনেছি। এই মতবিনিময়ে যে বিষয়টা পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে সেটা হল, সবাই একবাক্যে একটা কথা বলেছেন, এই ধরনের যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড— বাসে আগুন দেওয়া, ট্রেনে আগুন দেওয়া এবং জনজীবনকে স্থবির করে দেওয়া, রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়া, আক্রমণ করা, ট্রাকের ওপর আক্রমণ, নিরীহ মানুষ-পথচারী-বাসের যাত্রী এবং বিভিন্ন বয়সের মানুষ যেভাবে আক্রান্ত হয়েছে। যেভাবে প্রাণহানি হয়েছে, আহত হয়েছে, কারো পরিবারে হয়তো একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন, তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। স্কুটার ড্রাইভার বা রিক্সাওয়ালা যেভাবে আক্রান্ত হয়েছে— এগুলোর সবাই একবাক্যে নিন্দা করেছেন।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, ‘বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপানের প্রতিনিধিরা বলেছেন, এই ধরনের কর্মকাণ্ড গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কোনো অংশ হতে পারে না, একদম পরিষ্কার। ওআইসিভুক্ত দেশগুলো সবাই একবাক্যে বলেছে, অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের বিবেচনা করা উচিত যে যেসব দল এরকম কাজ করছে, এরকম গণবিরোধী কার্যক্রম করছে মানুষের উপর, নিরীহ মানুষের উপর হামলা করে, বোমা মারে, তাদের নিষিদ্ধ করা দরকার। শুধু মিসর, প্যালেস্টাইন নয় অন্যদেশগুলোও একই কথা বলেছে।’
আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘মোটামুটি তারা একমত এবং বাংলাদেশ সরকারকেও তারা এই বিষয়ে সমর্থন করবে, এই ধরনের প্রক্রিয়া যদি বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও একই কথা বলেছে। বিশেষ করে তাদের পার্লামেন্টে যে দুইটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল সেগুলো তাদের মনে করে দিয়েছি। সেখানে আছে যে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করবে যেসব দল তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। এটা কিন্তু জার্মানিতে আছে। হিটলারের যে দল নাৎসি পার্টি ছিল, নাৎসির আদর্শ অনুসরণ করে কোনো পার্টি জার্মানিতে স্থাপন করা যাবে না। এটা ওই দেশটির মৌলিক আইনে (বেসিক ল) বলা আছে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ওআইসির সদস্যভুক্ত যেসব রাষ্ট্র তাদের প্রতিনিধিরা এইখানে আমাদের বলছে, দেখো এটা সহ্য করা ঠিক হবে না, এসব দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত দেশগুলো তাদের পার্লামেন্টে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তারাতো সেটাকেই সমর্থন করবে। খুবই স্বাভাবিক এবং তারা সেটাই করেছে। এবং কঠোর ভাষায় তারা নিন্দা করেছেন এগুলোর।’
আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘এখন আজকে আমরা এইখানে এসে দাঁড়িয়েছি। গতকালকে (সোমবার) বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের বলেছেন, আমি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) টিভিতে দেখেছি, একজন সাংবাদিক তার কাছে জানতে চেয়েছেন (খালেদা জিয়া) যে, ঘটনাগুলো ঘটছে, আপনি অবরোধ ডেকেছেন, আপনি দায়িত্ব নেবেন কিনা। এর জবাবে তিনি (খালেদা জিয়া) বলেছেন, না, এগুলো বিএনপি করছে না, এগুলো করছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ পুলিশকে ব্যবহার করে এগুলো করছে। আজকে (মঙ্গলবার) ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের যখন এই কথা (অবরোধের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে খালেদা জিয়ার মন্তব্য) বলেছি আমি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী), তখন তারা মুচকি মুচকি হাসলেন।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কয়েকজন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, বারিধারা এবং গুলশানে একটি দেশের দূতাবাসের গাড়িতে বড়দিনের আগেরদিন পেট্রোলবোমা মারা হয়। আরেকটি দেশের রাষ্ট্রদূতের বেডরুমের পাশে বোমা ছোড়া হয়। ওই বাড়িটা প্রগতি সরণির দিকে মুখকরা। আমরা এগুলো পুলিশ প্রশাসনের নজরে এনেছি। নিরাপত্তা জোরদার করেছি। কিন্তু মূল কথা হল, যে ধরনের গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলছি, তারমধ্যে যদি এই ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটানো হয় তবে তার ফল কী হবে। এসব ঘটনায় গত কয়েকদিনে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কঠোর ভাষায় নিন্দা প্রকাশ করা হয়েছে। তারা এও বলেছেন যে এসব কর্মকাণ্ডকে শক্ত হাতে দমন করা হোক।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান, কোন কোন দেশ রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার জন্য বলেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এদের নাম বলা ঠিক হবে না। ওইটুকুই থাক। ওই দেশের কোন গ্রুপ তাতো বলেছি।’
মন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, সরকারের চাপের মুখে কূটনীতিকদের ব্রিফ করছেন কিনা। মন্ত্রী বলেন, ‘না, প্রশ্নই আসে না। এটা স্বাভাবিক কার্যক্রম। সব সময়েই বিদেশী কূটনীতিকদের দেশ সম্পর্কে জানানো হয়।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সাংবাদিকরা বলেন, এমন ঘটনাওতো ঘটছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধরে নিয়ে যায়, তারপর লাশ পাওয়া যায়। প্রতিনিয়ত এই ঘটনা ঘটছে। এই বিষয়টা কী কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনায় উঠে এসেছে। আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘না, সেটাতো আলাদা জিনিস। আপনি যেভাবে বর্ণনা করলেন যে প্রতিনিয়ত লাশ পাওয়া যায়, আমার মনে হয় না। এর কোনো ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না। প্রতিনিয়ত লাশ পাওয়া গেলে কতোগুলো লাশ হবে। আর আমরাতো লাশ বলি না, মরদেহ বলি।’
মন্ত্রীর কাছে সাংবাদিকরা জানতে চায়, নিষিদ্ধ করা বলতে বিএনপি এবং জামায়াত দুই দলকেই বোঝাচ্ছেন কিনা। মন্ত্রী বলেন, ‘না, আমি কিছুই বলছি না। আমি শুধু তাদের (বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক) কথা জানালাম।’
সহিংসতা কারা করে, আপনি দায় কার ঘাড়ে চাপাবেন। এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি এটা খুব পরিষ্কার। ইউরোপীয় পার্লামেন্টও বলেছে, এগুলো কে করে। তারাতো নাম দিয়েছে। আমি কোনোটাকে নিষিদ্ধ করতে বলিনি। তারা যা বলেছে, আমি সেটাই বললাম। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট তাদের নিষিদ্ধ করার কথা বলেছে। আর ওআইসি বলেছে, আইন করে নিষিদ্ধ করা হোক।’
সরকারের পক্ষ থেকে কূটনীতিকদের করা ব্রিফিংয়ে কোনো পক্ষ কী বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে কোনো প্রস্তাব করেছে? পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘না। এই ধরনের প্রস্তাব কেউ করেনি।’
দেশে বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পেছনে একটি নির্বাচনের দাবি রয়েছে। কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা।– সাংবাদিকরা জানতে চাইলে আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘না। বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে কেউই কিছু বলেননি। তারা বলেছে যে নাশকতামূলক যে কর্মকাণ্ড, এই যে সন্ত্রাস, এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ কখনো হতে পারে না। এই বিষয়ে সবাই একবাক্যে নিন্দা জানিয়েছে।’
বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে সংলাপ বা এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য কেউ কিছু বলেছেন কিনা। পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, ‘না। এই বিষয়ে কেউ কিছু বলেননি। তবে সবাই না। দুই একজন বলেছেন যে এইটা তোমাদের বিষয়, তোমরা সমাধান করে নাও।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে সাংবাদিকরা জানান, গত ১৪ জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারের বৈঠকের পর ওই জোটটি গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি দিয়ে জানায়, যাতে বিরোধীরা কথা বলতে পারে, সেজন্য স্পেস দেওয়ার জন্য। যা বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। আপনি কী মনে করেন, এই ধরনের পরিস্থিতিতে বিরোধীরা কথা বলতে পারছেন। আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘এটা হল কী, গণতান্ত্রিক স্পেসতো দিতে হবে। গণতান্ত্রিক সমাজে সার্বিক পরিস্থিতি যদি গণতান্ত্রিক হয়, তবে তো দিতে হবে। কিন্তু তার আগে এই যে সন্ত্রাস তাকে ত্যাগ করতে হবে। এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এই কথাটাই বলেছে বার বার। গত ডিসেম্বরে এ্যাপারেল সামিটে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের দক্ষিণ এশীয় প্রতিনিধি দলের চেয়ার (প্রধান) জিম ল্যাম্বার্ড, তিনি ব্রিটিশ মহিলা, তিনি সেখানে বলেছেন, যে ওইটা ছেড়ে দিতে হবে, সন্ত্রাসের পথ ত্যাগ করতে হবে।’
সামনে ফ্রেশ পোলের (জাতীয় সংসদ নির্বাচন) সম্ভাবনা আছে কিনা। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘নট এট অল (কোনো সম্ভাবনা নেই)’।
প্রসঙ্গত, গত ১৪ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে ডেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সরকারের অবস্থান জানান। গত ১৯ জানুয়ারি জাতিসংঘের প্রতিনিধিসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূতদের ডেকে সরকারের অবস্থান জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এরপর মঙ্গলবার দুই দফায় ওআইসি, সার্ক এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সম্পর্কে সরকারের অবস্থান জানান।
এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক ফোরাম এবং রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠানো হয়। ওইসব বিবৃতিতে বিদেশীরা বাংলাদেশের চলমান ঘটনায় নিন্দা ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। পাশাপাশি তারা চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য সবগুলো দলকে সংলাপে বসার আহ্বান জানান।