রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে আবারও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে। গত দুই দিনে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধে’ খোদ রাজধানীতেই দু’জন নিহত হয়েছেন। এরা দু’জনই সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা। এর আগে গত ১৬ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জে র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এক ছাত্রদল নেতা নিহত হয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত এই তিনজনের পরিবার এবং রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছে।
তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে ভিন্ন কথা। পুলিশ ও র্যাব দাবি করেছে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ই তারা নিহত হয়েছেন। এরা সবাই দেশে চলমান অবরোধে নাশকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। শুধু নাশকতাই নয়, এই তিনজনের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলারও অভিযোগ রয়েছে।
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ এনে ২০ দলীয় জোট ঢাকা ও খুলনা বিভাগে বুধবার সকাল থেকে ৪৮ ঘণ্টার হরতালের ডাক দিয়েছে। বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই হরতালের আহ্বান জানান।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, দুই বিভাগের জেলাসমূহে যৌথবাহিনীর অভিযানে ছাত্রদলসহ বিএনপির অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গুম-খুন-হত্যা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে এই হরতাল আহ্বান করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধে’ সর্বশেষ বিরোধী জোটের তিন নেতাসহ ২০১৫ সালের প্রথম ২০ দিনে সারাদেশে অন্তত ৭ জন নিহত হয়েছে।
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বাড়ছে।
আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ১২৮ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে বিরোধী জোটের অনেক নেতাকর্মীও রয়েছেন। অথচ ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭২।
অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি।
দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে আসকের প্রতিবেদন প্রকাশকালে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, ‘যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুন না কেন, তারা রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে সরকারি বাহিনীতে পরিণত করে। এ কারণেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড রোধ করা যায় না। মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আমরা যতই উদ্বেগ প্রকাশ করি না কেন, তারা বলতে চায় পরিস্থিতি যথেষ্ট ভাল। কিন্তু আমরা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে কথা বলি।’
চলমান অবরোধে তিন রাজনৈতিক নেতা নিহত
চলমান অবরোধে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবং রাজধানী ঢাকায় র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত তিনজনের মধ্যে দু’জন ছাত্রদল নেতা। অন্যজন জামায়াত নেতা।
সর্বশেষ মঙ্গলবার ভোরে খিলগাঁওয়ে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত নুরুজ্জামান জনি খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক।
পরিবার বলছে, পুলিশ পরিকল্পিতভাবে জনিকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। জনির বাবা ইয়াকুব আলী বলেন, ‘আমার ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। সোমবার দুপুরে জেলগেট থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার আর খোঁজ পাচ্ছিলাম না। আজ আমার ছেলের লাশ পেলাম।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপির রাজনীতি করার কারণে পুলিশ আমার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।’
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ দাবি করেছে, গোয়েন্দা পুলিশের হাতে আটক জনিকে নিয়ে অভিযানে গেলে নাশকতাকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে পুলিশও পাল্টা গুলি ছুড়ে। এরপর জনি বন্দুকযুদ্ধের কবলে পড়ে নিহত হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ‘জনি একজন নাশকতাকারী। মৎস্য ভবনে পুলিশের গাড়িতে বোমা হামলার ঘটনায় সে জড়িত ছিল।’
জনির সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, শরীরে ১৭টি গুলির চিহ্ন রয়েছে। এর মধ্যে বাম কোমরে একটি, বুকের মাঝ বরাবর তিনটি, বুকের বামপাশে দু’টি, বুকের ডানপাশে তিনটি, পিঠের বামপাশে তিনটি, পিঠের বামপাশের উপরে দু’টি, পিঠের ডানপাশের উপরে একটি, পিঠের মাঝামাঝি একটি এবং ঘাড়ের বামপাশে একটি গুলি লেগেছে।
অর্থাৎ তার শরীরের চারদিকে গুলি লেগেছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ সাদিয়া তাজনীনের উপস্থিতিতে সুরতহাল রিপোর্টটি তৈরি করেন খিলগাঁও থানার একজন উপ-পরিদর্শক (এসআই)।
এর আগের দিন সোমবার ভোরে মতিঝিলে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত নড়াইল পৌরসভার কাউন্সিলর ও জামায়াত নেতা ইমরুল কায়েসকেও পুলিশ ধরে নিয়ে হত্যা করেছে বলে পরিবার অভিযোগ করেছে। একই অভিযোগ করেছে জামায়াতে ইসলামীও।
নড়াইল জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মো. আবু ফাইজা জানান, দুই দিন আগে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে ঢাকার একটি মেস থেকে ইমরুল কায়েসকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। সোমবার দুপুরে জানা যায়, পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে কায়েস নিহত হয়েছে।
ইমরুল কায়েসের ভাই ওয়েজ জানান, নিখোঁজের পর সোমবার দুপুরের দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ফোনে তার ভাইয়ের নিহতের খবর জানতে পারেন।
তবে গোয়েন্দা পুলিশের দাবি, কায়েসসহ আরও কয়েকজন নাশকতার উদ্দেশ্যে এজিবি কলোনিতে অবস্থান করছিল। গোয়েন্দা পুলিশ তাদের চ্যালেঞ্জ করলে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এরপর পুলিশ পাল্টা গুলি ছুড়লে কায়েস গুলিবিদ্ধ হয়। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বলেন, ‘নিহত কায়েসের কাছ থেকে পাওয়া ফোনের সূত্রে জানা যায়, সে নড়াইলের পৌর কাউন্সিলর ও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সে নাশকতার বিষয়ে বেশ অভিজ্ঞ। তার বিরুদ্ধে নড়াইলে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে নড়াইল থানায় হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মামলা রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশকে আক্রমণ করে নাশকতা করাই তার মূল লক্ষ্য। সে এই উদ্দেশ্যেই ঢাকায় অবস্থান করছিল।’
কায়েসের সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, কায়েসের বুকের বাম পাশে ৬টি ছিদ্র পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বাম হাতের কনুইয়ের নিচে একটি, ডান বগলের নিচে একটি, ডান বাহুতে একটি, ঘাড়ের ডানপাশে একটি, পিঠের বামপাশে তিনটি ও কোমরে দু’টি ছিদ্র পাওয়া গেছে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নুসরাত জাহান নিশোর উপস্থিতিতে মতিঝিল থানার একজন উপ-পরিদর্শক (এসআই) সুরতহাল রিপোর্টটি তৈরি করেন।
গত ১৬ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় র্যাবের সঙ্গে ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধে’ মতিউর রহমান নামে এক ছাত্রদল নেতা নিহত হয়েছে।
এই ঘটনায়ও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে মতিউরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। মতিউর শ্যামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি।
মতিউরকে পরিকল্পিতভাবে র্যাব হত্যা করেছে দাবি করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি মো. শাহজাহান মিঞা বলেন, ‘র্যাব মতিউরকে আটক করে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। তার বিরুদ্ধে কোনো থানায় মামলা বা জিডি নেই। অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাটিও সাজানো।’
তবে র্যাবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, মতিউর বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। সে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তার নেতৃত্বে শিবগঞ্জে ট্রাকে আগুন ও পুলিশের ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ রয়েছে।
র্যাব-৫ এর চাঁপাইনবাবগঞ্জ ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর কামরুজ্জামান পাভেল জানান, নাশকতার অভিযোগে যৌথবাহিনীর হাতে আটক মতিউরকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গেলে ৪০-৫০ জন র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এরপর র্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। মতিউর পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
সূত্র: দ্যা রিপোর্ট