বোমা বানানোর সময় বিস্ফোরণে আহত ৩ :‘তারা বোমাবাজ জানলে ছেলেরে কখনোই পাঠাইতাম না’
‘পাশের ঘরে বিকট শব্দ। দরজা খোলাই ছিল। অন্ধকার ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পুরো শরীরে রক্তমাখা এক শিশু চিৎকার করে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি তাকে কোলে করে বাইরে নিয়ে আসব, এমন সময় ঝুমুর আমাকে বলল, আমার ভাইকে বাঁচান। এরপর ওই শিশুকে আমি বাইরে নিয়ে আসি। আমার সারা শরীর তখন রক্তে ভিজে গেছে।’
রাজধানীর লালবাগের ঢাকেশ্বরী রোডের ৩১/২ নম্বর বাসার দোতলার একটি কক্ষে বোমা বানানোর সময় বোমা বিস্ফোরণে ক্ষতবিক্ষত শিশু রিপনকে উদ্ধারের ঘটনা এভাবেই বর্ণনা করলেন প্রতিবেশী সুফিয়া বেগম। তিনি ওই বাড়ির মালিক আবুল কাশেমের স্ত্রী। বুধবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় হ্যাপী আক্তার নামে ১২ বছরের এক কিশোরী ও তার মামা বোমা কারিগর বাপ্পী আহত হয়। বাপ্পীর ডান হাত বোমায় বিচ্ছিন্ন হওয়ার পাশাপাশি সারা শরীরে স্প্লিন্টার ঢুকে গেছে। পুলিশ জানিয়েছে, বাপ্পী নিউমার্কেট থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক।
আহতরা সবাই এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন।
সুফিয়া বেগম জানান, ঘরে বোমা বানানোর বিষয়ে তারা কিছুই জানতেন না। ঝুমুরের ঘরে তার আসা-যাওয়া থাকলেও তিনি কখনোই তা টের পাননি।
তিনি জানান, এক মাস আগে বাপ্পীর বোন ঝুমুর আক্তার ও তার স্বামী আজিজুল হাকিম আট হাজার টাকায় বাসা ভাড়া নেয়। অগ্রিম ২০ হাজার টাকাও দিয়েছিল। দুই কক্ষের ওই বাসায় বাপ্পীও থাকত।
বোমা আহত শিশু রিপনের বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারেননি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কথা হয় রিপনের মা লিপি আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, ঝুমুর আক্তার এর আগে এলিফ্যান্ট রোডে ভাড়া থাকত। তখন থেকেই ঝুমুরের পরিবারের সঙ্গে সখ্য তৈরি হয়। এই সূত্র ধরেই হ্যাপী আজ (বুধবার) রিপনকে তাদের বাসায় নিয়ে যান।
তিনি বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘আল্লাহ আমারে এত বড় শাস্তি কেন দিল? আমার এই শিশু সন্তানের কি অপরাধ? আমি যদি জানতাম তারা বোমাবাজ, আমার ছেলেরে কখনোই পাঠাইতাম না।’
তিনি বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘আমার ছেলেটা সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেল।’ এই বলে তিনি বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। রিপনের বাবার নাম নাজিমুদ্দিন বাচ্চু। তিনি কাঁটাবনের পাখি ব্যবসায়ী।
পুলিশ বলছে, বোমা বানানোর সময় আহত বাপ্পী ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সে কাঁটাবন এলাকায় বোমা বাপ্পী নামে পরিচিত।
গোয়েন্দা পুলিশের বোমা জিসপোজাল ইউনিটের এক কর্মকর্তা জানান, আলামত দেখে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, বোমা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় এই বিস্ফোরণ ঘটে। এমন হতে পারে, ভুল কানেকশনের কারণে এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
লালবাগ জোনের উপ-কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বাপ্পী একজন বোমাবাজ। সে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সে বোমা বানায় এবং সংগ্রহ করে।’
বোমা বানানোর সময় বিস্ফোরণ ঘটেছে এ বিষয়টি আপনারা নিশ্চিত করে বলছেন কিভাবে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঘটনার পরই বোমা ডিসপোজাল ইউনিট এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, আলামত সংগ্রহ করে। এসব বিষয় বিশ্লেষণ করে তারা নিশ্চিত হয়েছে, বোমা বানানোর সময়ই এই বিস্ফোরণ ঘটে।’
আলামতের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাপ্পীর শরীর স্প্লিন্টারের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। চৌকিও ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ডান হাত উড়ে গেছে।’
তিনি আরও জানান, এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সন্দেহে ১০ জনকে পুলিশ আটক করেছে। এরমধ্যে বাড়ির মালিক আবুল কাশেমও রয়েছেন। এছাড়া বাপ্পীকে হাসপাতালে দেখতে এসে শামীম ও ফারুক নামে দুইজন পুলিশের হাতে আটক হন।
পুলিশ এই ঘটনাকে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা মনে করলেও ঝুমুর আক্তার দাবি করেছেন, দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় রুমহিটার বিস্ফোরিত হয়। এতে তারা আহত হন।
তবে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় বারুদের গন্ধ পাওয়া গেছে। আহতদের শরীরও স্প্লিন্টারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। বিশেষ করে বাপ্পীর পুরো শরীরেই স্প্লিন্টারের আঘাত রয়েছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে দেখা গেছে, ওই বাড়ির দোতলায় ছোট ছোট দুটি কক্ষ। দুই কক্ষেই অসংখ্য মালামাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তবে পুলিশ কাউকেই ওই দুটি কক্ষে ঢুকতে দেয়নি। কক্ষের বাইরে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখা গেছে।