গন্তব্যহীন অনিশ্চয়তায় গণতন্ত্র
গন্তব্যহীন অনিশ্চয়তার পথে হাঁটছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র। দেশের প্রধান দুই বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মুখোমুখি সাংঘর্ষিক অবস্থানের কারণে বিপদের মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা। সংশ্লিষ্টরা এমনটাই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। তাদের মতে, দুই দলের অনড় অবস্থানের কারণে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট দিন দিন আরও চরমে পৌঁছাচ্ছে। সমঝোতার পথে না গিয়ে তারা বেছে নিয়েছেন সাংঘর্ষিক অবস্থান। এ সুযোগে দেশে ধ্বংসাত্মক অপরাজনীতি গণতন্ত্রের ঘাড়ে চেপে বসছে। এ ধারা চলতে থাকলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।দেশের প্রধান দুই দলের প্রধান সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ পায় দেশের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হকের কথায় । তিনি বলেন, ‘দুই নেত্রী নিজেদের দেশের রাণী ভাবেন। তাদের এই মুখোমুখি অবস্থানই এক সময় কাল হয়ে দাঁড়াবে। ওয়ান ইলেভেনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তারা কোনো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি। তাদের মধ্যে যত দ্রুত শুভবুদ্ধির উদয় হবে তা যেমন দেশবাসীর জন্য মঙ্গল, তেমনি তাদের জন্যও মঙ্গল।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান অস্থির পরস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। অর্থনীতির চাকা পেছনের দিকে ঘুরছে। বিদেশী ক্রেতারা ফেরত যাচ্ছে। আমদানি-রফতানিতে ভাটার টান। গণপরিবহন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। কৃষক তার উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাত করতে পারছেন না। অন্যদিকে সারের ব্যাপক চাহিদার মৌসুমে চাহিদা অনুযায়ী সার মিলছে না। এর ফলে কৃষক যেমন উৎপাদিত ফসলের দাম পাচ্ছে না, তেমনি ভবিষ্যত উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
টানা অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বছরের প্রথম দিনে সবার হাতে নতুন বই পৌঁছে গেলেও বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠানে এখনো পড়াশুনাই শুরু হয়নি। এর মধ্যে আবার সোমবার থেকে একযোগে সারাদেশে শুরু হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা। প্রায় পৌনে ১৫ লাখ পরীক্ষার্থী এই পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা। তারা জানে না কি আছে তাদের ভাগ্যে। চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে শিক্ষার্থীদের। উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। উৎকণ্ঠা আর ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে তাদের দিন কাটছে। এসএসসি পরীক্ষার মধ্যেই ২০ দলীয় জোট রবিবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশব্যাপী ৭২ ঘণ্টা হরতাল ডেকেছে।
অবস্থা থেকে উত্তরণে রাজনীতিক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, ব্যবসায়ী নেতারা, সাংবাদিক সমাজ, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন সংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন।
বস্ত্র ও পোশাক খাতের প্রধান সংগঠনসহ এ খাতে সম্পৃক্ত ৪০টি সংগঠন বুধবার দুই নেত্রীর কাছে পৃথক স্মারকলিপিতে বলেছেন, ‘পোশাক শিল্পকে বাঁচান। আমরা বাঁচতে চাই।’
এরও আগে গত ১০ জানুয়ারি ব্যবসায়ীদের প্রধান সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ- এফবিসিসিআই’র শীর্ষ নেতারা দুই দলকে সমঝোতায় আসার আহ্বান জানান। একই দিন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন চলমান সঙ্কট নিরসনে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ কামনা করে বলেছে, আশা করছি দেশের এমন পরিস্থিতিতে একজন সম্মানীয় ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রপতি উদ্যোগ নেবেন।
এদিকে, সাত দিনের মধ্যে দুই নেত্রী আলোচনায় না বসলে আমরণ অনশনে বসার ঘোষণা দিয়েছেন দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। দুই নেত্রীকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে মতিঝিলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ইতোমধ্যেই অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী।
চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধানে দুই নেত্রীকে সংলাপে বসার দাবি জানিয়ে শনিবার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেলা ৩টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন নাগরিক ঐক্যের প্রধান মাহমুদুর রহমান মান্না। গণফোরাম, সিপিবি, বাসদ, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য সঙ্কট সমাধানে দুই নেত্রীকে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়ে যুগপৎভাবে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।
এর আগেও রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের প্রস্তাব এসেছে। দেশী-বিদেশী রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের পাশাপাশি জাতিসংঘও সংলাপ আয়োজনের সঙ্গে জড়িয়েছে। গত বছরের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতাসীন সরকারকে সংলাপে বসার আহ্বান জানান জাতিসংঘের মহাসচিব। এ জন্য তিনি তার বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্ডেজ তারানকোকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি ও তাদের শরিকদের অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচন হয়েছে। সেই নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে আবারও রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে সব দলের অংশগ্রহণে সংলাপের দাবি উঠছে।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘দুই দলের জেদাজেদি, প্রতিহিংসা, রাগ-ক্ষোভের শিকার হচ্ছে জনগণ। সংঘাত ও গণতন্ত্র একসঙ্গে চলতে পারে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন আলোচনায় বসা এবং সংকট নিরসনের উপায় উদ্ভাবন করা।’
ড. কামাল হোসেন আরও বলেন, ‘অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, দেশের মালিক জনগণ নয়, মালিক তথাকথিত দুই বড় দল। এক দল দেশকে পুলিশী রাষ্ট্র বানিয়ে জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চায়। আর এক দল সহিংসতার পথ বেছে নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান বলেন, ‘বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ সংলাপ। সংলাপে বসে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। আর না পারলে সমস্যার সমাধান হবে না, না হলে দিন দিন পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে।’
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘সিরিয়া, মিসর, ইরাক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়াসহ পৃথিবীতে এমন প্রায় গোটা বিশেক দেশ সহিংসতার মধ্য দিয়ে চলছে। আমরাও হয়ত দিনে দিনে সেই দেশগুলোর কাতারে শামিল হচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘একই মানসিকতা আমাদের এখানকার বিবদমান দুই বড় দলের মধ্যেও কাজ করছে। তারাও ওই সব দেশের এই ফর্মুলা অনুসরণ করছে। আমাদের দুই বড় দলও মনে করছে তারা যার যার অবস্থানে সর্বতোভাবে সঠিক।’
ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘এখন দেখার বিষয়, আমাদের দেশের এই সহিংসতার মাত্রা সামান্য, মধ্যম না চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।’
সমঝোতায় পৌঁছতে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে কোনো সুফল বয়ে আনবে না দাবি করে ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। তার পরও তিনি চাইলে উদ্যোগ নিতে পারেন।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘রাজনীতিতে যে সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে। সংলাপ বা সমঝোতা ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। কিন্তু সরকার একগুঁয়েমি নিয়ে জনগণের দাবি উপেক্ষা করে দেশকে ভয়াবহ সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যার দায়-দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি চলমান সঙ্কট নিরসনে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। আর এই সংলাপ আয়োজনের উদ্যোক্তা হিসেবে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সঙ্কটের সমাধান না হলে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-জ্বালাও-পোড়াও-হানাহানি বাড়তেই থাকবে। গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। জনগণের পাশাপাশি যার খেসারত বড় দুই দলকেও দিতে হবে। অতীত অভিজ্ঞতা এমনটাই বলে।’
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘দেশের মানুষ শান্তি চায়। নিরাপত্তা চায়। শান্তিতে বসবাস করতে চায়। একই সঙ্গে কাজকর্ম করে খেতে চায়। কিন্তু বড় দুই দল জনগণকে গরু-ছাগল ভেবে তাদের জিম্মি করে রেখেছে। দুই দলের হিংসা-প্রতিহিংসা, রাগ-ক্ষোভের শিকার হচ্ছে জনগণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ অবস্থা বেশী দিন চলতে পারে না। হিংসা-হানাহানির রাজনীতির অবসান হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের প্রতিনিধি এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে আলাপ-আলোচনায় বসা। একটি সমঝোতার পথ খুঁজে বের করা। প্রয়োজনে এ জন্য গণভোটেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’