সুর পাল্টাচ্ছে সরকার
সুর পাল্টাচ্ছে সরকার। কঠোর অবস্থানে থাকা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাময়িকভাবে নরম অবস্থানে নেমে এসেছে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচি ঘিরে সৃষ্ট নাশকতার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে আসছিল দলটি। কিন্তু গত দুই দিনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী মহলের অনেক মন্ত্রী ও নেতার বক্তব্যে নরম সুর ধ্বনিত হয়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বক্তব্য নরম অবস্থানের লক্ষণ পাওয়া গেছে।
একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে সর্বোচ্চ মহলের ইঙ্গিতেই সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী নরম সুরে কথা বলছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান অফিসের বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন সংযোগ গত শুক্রবার মধ্য রাতে বিচ্ছিন্ন করে সরকার সর্বশেষ কঠোর অবস্থান জানান দেয়। এ নিয়ে সর্বত্র তোলপাড় হতে থাকলে শনিবার রাতেই গুলশান অফিসে বিদ্যুতের পুনঃসংযোগ দেওয়া হয়। ২ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষা শুরু করা নিয়ে সরকারের অবস্থান ছিল কঠোর। শিক্ষামন্ত্রী রবিবার এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে দিয়ে এখানেও নরম অবস্থান গ্রহণ করেছে। এ সব ছিল সরকারের অবস্থান বদলানোর নমুনা। এমনটাই মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে গত দুই দিনে আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী মহলের অনেক মন্ত্রী ও নেতার বক্তব্যে নরম সুর ধ্বনিত হয়েছে। শনিবার সকালে মহাসড়ক উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দলের শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দেশের স্বার্থে সরকার অনড় থাকবে তাও মনে করার কারণ নেই। আইজিপি শহীদুল হক বলেন, শর্তসাপেক্ষে বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হবে।
একই দিন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, সংলাপ চাইলে খালেদাকে জঙ্গিবাদ ছাড়তে হবে। সংলাপ চাইলে খালেদা জিয়াকে ছাড়তে হবে রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গ। অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক ও সহিংসতার পথ পরিহার করে গণতন্ত্র ক্লাবের সদস্য হতে হবে। আর তখনই তার সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত ‘মিট দ্য রিপোর্টার্স’ অনুষ্ঠানে হাসানুল হক ইনু এ সব কথা বলেন।
সরকারের এ সব মহলের বক্তব্যগুলো ইঙ্গিতপূর্ণ। এতে মনে হয় সরকার নরম অবস্থান গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন মহলে এ আলোচনা চলছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও নাম গোপন রাখার শর্তে সরকারের নরম অবস্থানের কথা স্বীকার করেছেন। তবে কেউ কেউ বলছেন, সরকার পরিচালনা করতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হয়। সরকারের নরম অবস্থান গ্রহণ করা এক ধরনের দায়িত্বশীলতা ও কৌশল। এটাকে দুর্বল ভাবা যাবে না।
এ সব ঘটনা—কয়েকজন মন্ত্রী ও দায়িত্বশীল নেতার বক্তব্যের সূত্র ধরে এর অন্তর্নিহিত কারণ জানতে চাইলে সরকারের নরম অবস্থান গ্রহণের কথা জানান আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা। তারা জানান, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকার তার কঠোর অবস্থান পরিবর্তন করতেই পারে। তারা জানান, অবস্থানের পরিবর্তনকে দুর্বলতা ভাবা কারোরই ঠিক হবে না।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, সরকারের অনেক দায়-দায়িত্ব। পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনিশ্চয়তার মধ্যে এতগুলো পরীক্ষার্থীকে ফেলে দেওয়া ঠিক হবে না মনে করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সরকারের নরম অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের এই নেতা বলেন, সরকার সার্বিক পরিস্থিতি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সামাল দিতে চায়। এ জন্য কখনো কখনো নমনীয় অবস্থানও নেওয়া হতে পারে। তিনি এও বলেন, কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা হবে বলা হলেও আমরা (সরকার) এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা প্রসঙ্গে এই নেতা বলেন, আমাদের শ্রমিক নেতা ও মন্ত্রী শাজাহান খান এ ধরনের কথা বলার পর শ্রমিকরা এ সব সংযোগ বন্ধ করে দেয়। তবে সরকার যখন জানতে পারে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে তখন পুনরায় সংযোগ দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। জনগণের স্বার্থে কঠোর-নরম হওয়া স্বাভাবিক। তবে এটাকে কোনো মহল দুর্বলতা ভাবলে ভুল হবে।
শীর্ষ পর্যায়ের এক মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সচিবালয়ে তার দফতরে বিকেলে একান্ত আলাপে এ প্রসঙ্গে বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকার তার সিদ্ধান্ত বদল করতে পারে। যদি গরম অবস্থানে গিয়ে সৃষ্ট নাশকতা দমন করতে পারে তাই করবে। আর নরম অবস্থানে গিয়ে যদি পরিস্থিতির উন্নতি হয় তাও করবে। তবে বেগম জিয়ার কার্যালয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্নকে অতিউৎসাহী একটি মহলের দুষ্টু কাজ বলে মন্ত্রব্য করেছেন শীর্ষ এ নেতা।
এদিকে এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের কয়েকজন সম্পাদকমণ্ডলীর নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে দিয়ে বিএনপির হরতাল কর্মসূচিকে উৎসাহিত করা হল। সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা বলেন, গত দুই দিন যাবৎ আওয়ামী লীগ নেতারা কেন্দ্র থেকে সারাদেশে তৃণমূল নেতাদের কাছে ফোন করেন। তাদের দিক-নির্দেশনা দেন পরীক্ষা কেন্দ্র পাহারা দেওয়ার। তিনি বলেন, হঠাৎ এ পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতাদের নিরুৎসাহিত করবে। কারণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যে কোনো মূল্যে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের সহোযোগিতা করার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়।