আন্দোলন নিয়ে দুই নেত্রীর কৌশল, জানেন না শীর্ষ নেতারা
দেশের চলমান পরিস্থিতিতে দুই নেত্রীর অনড় অবস্থান সম্পর্কে তাদের দলের শীর্ষ নেতারা অন্ধকারে রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন নিজ নিজ অবস্থান থেকে তারা সার্বিক পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে নিতে মরিয়া। আন্দোলন সফল ও দমনের বিষয়ে তারা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা নিচ্ছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রথমসারির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
দলের শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের নিয়ে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়তই বৈঠক করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে সার্বিক পরিস্থিতি নিরসনে করণীয় সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী একাই গ্রহণ করছেন। এক্ষেত্রে অন্ধকারে থেকে যাচ্ছেন দলের শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রীরা।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সরকারবিরোধী আন্দোলনে নিজেই নেতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কর্মসূচি প্রণয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে কোনোক্রমেই যেন তা বাইরে প্রকাশ না পায়, সে জন্য দলের শীর্ষ নেতাদের অন্ধকারে রেখেই কর্মসূচি বাস্তবায়নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন খালেদা জিয়া। তবে দলের শীর্ষ নেতাদের প্রতি খালেদা জিয়ার নির্দেশ ছিল— তারা যেন যোগাযোগের জন্য তাদের মোবাইল ফোন খোলা রাখেন। প্রয়োজনে যাতে তাদের সঙ্গে কথা বলা যায়। কিন্তু সম্প্রতি খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসের মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় এখন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দলের শীর্ষ নেতাদের যোগাযোগও অনেকটাই বিচ্ছিন্ন।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, দলের নেতাদের কাছ থেকে মতামত নিলেও প্রধানমন্ত্রী কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বা নিবেন তা কাউকে জানানো হয় না। এমনকি প্রধানমন্ত্রীকে কারা দেশের সার্বিক অবস্থা জানাচ্ছেন তাও দলের শীর্ষ নেতারা জানেন না।
সর্বশেষ রবিবার রাতে সংসদ ভবনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে অনেকের বক্তব্যই মনোযোগ দিয়ে শুনেন প্রধানমন্ত্রী। তারপর তিনি তার বক্তব্য রাখেন। তবে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তের কথা তিনি কাউকে জানাননি।
সংসদীয় কমিটির সভায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘বর্তমান সহিংসতা নিরসনে প্রয়োজনে সংসদের অধিবেশন দুই সপ্তাহ স্থগিত রাখা যেতে পারে।’ পরে এ প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। এমন অনেক প্রস্তাবই প্রধানমন্ত্রীকে অনেকে দেন, তবে সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী একাই।
এরপর দলের কিছু জ্যেষ্ঠ নেতাকে নিয়ে গণভবনে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানেও অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি সর্ম্পকে সম্যক ধারণা নেন তিনি। তবে কোনো কথা না বলে সিদ্ধান্ত পরে সবাইকে জানানোর কথা বলেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সকল সিদ্ধান্তই সবার মতামত নিয়ে নেওয়া হয়। আর আমাদের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা শুক্রবার।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা সোমবার দুপুরে বলেন, ‘দেশে এ সব কী হচ্ছে, আমরা সবাই অন্ধকারে। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নের ঘটনায় আমরা হতবাক। কারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তার কিছুই আমরা বুঝতে পারছি না।’
তিনি জানান, যে যাই করুক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব বিষয়েই অবগত রয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘আগামী শুক্রবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হবে।’
চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান রবিবার রাতে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে পারব না। কারণ আমি আজকে (রবিবার) গুলশান অফিসে যাইনি।’
নতুন কোনো কর্মসূচি আসছে কিনা— এ প্রসঙ্গে জেনারেল মাহবুব বলেন, ‘ম্যাডামের সঙ্গে দুই-এক দিনের মধ্যে আমার দেখা ও কথা হয়নি। তাই আন্দোলন সম্পর্কে এ মুহূর্তে কিছুই বলা যাচ্ছে না।’
দলের আরেক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) সফল আন্দোলনের পথে হাঁটছেন। যে কোনো মূল্যে তিনি সফল আন্দোলন দেখাতে চান। ম্যাডাম নিজেই কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কৌশল অবলম্বন করছেন।’
তিনি বলেন, ‘দলের দায়িত্বপ্রাপ্তরা কেউ গ্রেফতার হলে কার পর কে দায়িত্ব পালন করবেন তা ম্যাডামই ঠিক করেন। তবে কে কার পর দায়িত্ব পালন করবেন তাও তিনি গোপন রেখেছেন। আন্দোলন শুরু হওয়ার পার থেকেই সকল সিদ্ধান্ত ম্যাডাম একাই নিচ্ছেন।’
গত ২৯ জানুয়ারি রাতে দলের স্থায়ী কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্য খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। এর মধ্যে ড. আর এ গনি, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সারোয়ারি রহমান, ড. আবদুল মঈন খান ও নজরুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন।
তবে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এসে কার্যালয়ের সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে এসেছিলাম। এ সময় কোনো রাজনৈতিক আলোচনা হয়নি।’
ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে সমবেদনা জানাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসবেন সে বিষয়টি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জানতেন না বলে দলটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী গুলশান কার্যালয়ে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ আগে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস গণমাধ্যমকে জানান, শোকে কাতর অসুস্থ খালেদা জিয়াকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী গুলশান কার্যালয়ের সামনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে যান। ২৪ জানুয়ারি রাতে এ ঘটনা ঘটে। এতে অনেকটাই পরিষ্কার হয় সাম্প্রতিককালে খালেদা জিয়া যে কোনো সিদ্ধান্ত একাই নিচ্ছেন। তাকে ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না দলের নেতারা।
এর একদিন পরই দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এমনটাই ইঙ্গিত দিয়েছেন। ওই দিন তিনি গুলশান অফিসের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আসার ব্যাপারটি দেশনেত্রী অজ্ঞাত ছিলেন। তিনি সে সময় প্রায় অজ্ঞানের মতো ছিলেন। আমরা কেউ তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাইনি। দরজা বন্ধ থাকায় প্রধানমন্ত্রী আসার খবরও তাকে জানানো সম্ভব হয়নি।’