কেন নিশ্চুপ সৈয়দ আশরাফ
সরকার ও দলে যখনই দুঃসময় এসেছে তখনই চালকের আসনে বসতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছায়াসঙ্গী হিসেবে কাজ করে অনেক চ্যালেঞ্জ উতরে গেছেন আশরাফ। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি যখন সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নেমেছে সে সময়ে রাজনৈতিক ময়দানে আশরাফের অনুপস্থিতি কোনোভাবেই স্বাভাবিক হিসেবে নিতে পারছেন না দলের নেতাকর্মীরা।
চলমান পরিস্থিতিতে সৈয়দ আশরাফের নিষ্ক্রিয়তা প্রসঙ্গে একটি সূত্র জানায়, এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় দলের ভেতরে তার সঙ্গে বোঝাপড়া বা কৌশল নির্ধারণী সিদ্ধান্তে গরমিল দেখা দিয়েছে। এটাই তার নিষ্ক্রিয়তার মূল কারণ হতে পারে। ওই সুত্রটি জানায়, আশরাফ মনে করেন দমন-পীড়ন ছাড়াও এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। সূত্রটির মতে, সাধারণ সম্পাদক আশরাফের সঙ্গে দলের অন্য নেতৃত্বের নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝি চলছে বলেই হয়ত এই দূরে থাকা। তবে সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আশরাফ শান্তিপ্রিয় মানুষ, তাই নিশ্চুপ রয়েছেন। তিনি যখন সক্রিয় হবেন বা মুখ খুলবেন তখন ‘মিন’ (দায়িত্ব নিয়ে) করেই করবেন। সভাপতিমণ্ডলীর অপর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, এ বিষয়ে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তাছাড়া আওয়ামী লীগ তো রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছে না।
সংসদ ভবনে গত রবিবার সংসদীয় দলের সভায় সৈয়দ আশরাফ উপস্থিত থেকে সবার কথা শুনেছেন। চলমান পরিস্থিতি নিয়ে দলের বেশিরভাগ নেতা কথা বললেও সেখানে আশরাফ নিজে কোনো কথা বলেননি বলে নিশ্চিত করেন বৈঠকে উপস্থিত দুইজন দলীয় সংসদ সদস্য। এদিকে সচিবালয়ে নিজ দফতরেও যান না স্থানীয় সরকার মন্ত্রী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকেও অনুপস্থিত ছিলেন তিনি। মিডিয়ার সামনেও আসছেন না তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যমতে, মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে গত কয়েক দিনে দলের বেশ কয়েকজন নেতা যাতায়াত করলেও ঘনিষ্ঠ এক-দুইজন ছাড়া অন্যদের সঙ্গে সাক্ষাতও দেননি সৈয়দ আশরাফ। গণভবনেও যাতায়াত খুব একটা নেই সৈয়দ আশরাফের।
অনেকে মনে করছেন দলের ও দেশের চূড়ান্ত প্রয়োজনে ত্রাণকর্তা হিসেবে ঠিকই হাজির হবেন তিনি। এর আগে তার ভূমিকা সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে যেমন সিদ্ধহস্তে কাজ করেছেন, তেমনি নির্বাচনের পরে দেশী-বিদেশী জনমত গঠনের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে দ্বিতীয় শীর্ষ এ নেতাকে। ৫ মে ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচিকে নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। সব মিলিয়ে পর পর আওয়ামী লীগের দুইবারের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সরকারবিরোধী আন্দোলন ঘোষণার পর বিরাজমান পরিস্থিতিতে আশরাফের নিষ্ক্রিয়তা ও নিজেকে গুটিয়ে রাখা নিয়ে সর্বত্র জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে প্রায় সব নেতাকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে, সেখানে দেশে থেকেও কেন নিশ্চুপ আওয়ামী লীগের মুখপাত্র সৈয়দ আশরাফ— সেই প্রশ্ন সবার মধ্যে। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মুখ না খুললেও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সৈয়দ আশরাফের খানিকটা ব্যস্ততা দেখা গেছে। গত মাসে আওয়ামী লীগের দুটি জেলা সম্মেলনে যেতে দেখা গেছে তাকে। চলতি মাসে আরও দুই-একটি জেলা সম্মেলনে যাওয়ার কথা রয়েছে সৈয়দ আশরাফের।
এর কারণ জানতে দ্য রিপোর্টের পক্ষ থেকে একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে আলাপ করা হয় কিন্তু সদুত্তর পাওয়া যায়নি কারো কাছ থেকে। সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা বলেন, আশরাফ ভাই নিজেকে নিজে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য জানান, অনেক দিন যাবত আশরাফ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা নেই তাই এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারব না। আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা আরও বলেন, চলমান আন্দোলন নিয়ে কেবল বাইরেই নয়, দলের ভেতরের বৈঠকেও তেমন কোনো কথা বলতে সৈয়দ আশরাফকে দেখা যায়নি। এ প্রসঙ্গে সম্পাদকমণ্ডলীর অপর এক নেতা অবশ্য ভিন্নভাবে জানান, মানববন্ধন, সভা-সমাবেশে উপস্থিত থাকলেই কেবল সক্রিয় থাকা বোঝায় না। এর বাইরেও সক্রিয় থাকার অনেকগুলো উপায় আছে। অবশ্য এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আশরাফের প্রতিক্রিয়া জানতে সোমবার বিকেলে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকরা এ সময়ে তার বিদেশে পড়ে থাকা সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না। তাদের মতে, গত বছর হেফাজতের ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে সরকারের সব মহলই যখন দিশেহারা, ঠিক তখনি চালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন আশরাফ। ওই দিন সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে হেফাজতকে ঢাকা থেকে উচ্ছেদ করেন। সেই দিন আশরাফের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখে অনেকেই হতবাক হন। আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতারাও আশরাফের সেদিনের ভূমিকায় অবাক হন।
গত বছরের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে যে আশরাফ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছায়াসঙ্গী হয়ে কাজ করেছেন। বিদেশীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছেন এবং জাতিসংঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সঙ্গে বৈঠক করে যুক্তিতর্কে তাকে পরাজিত করে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে তাতে রাজি করান।
নির্বাচনপরবর্তী পরিস্থিতিতেও আশরাফের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। সরকারের পক্ষে দেশী-বিদেশী সমর্থন আদায়ে দিনরাত কাজ করেছেন। আর তাতে সাফল্যও মিলেছে। কিন্তু বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনে কেন তার দূরে থাকা। তবে দলের অপর একটি অংশ মনে করে— আশরাফের সক্রিয় হওয়ার সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি।