এখনও বিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট, টেলিফোন : গুলশান অফিসে খালেদার ৩০ দিন
গুলশানের নিজ অফিসেই ৩০ দিন পার করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ সময়ে কখনও পুলিশি বেষ্টনীতে অবরুদ্ধ, কখনও নিজেই অবরুদ্ধ, কখনওবা বিদ্যুৎহীন অন্ধকারে মোমবাতির আলোতে সময় কাটিয়েছেন। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতেও তিনি অফিস ত্যাগ করেননি।
পুত্রশোক কাটিয়ে ওঠার আগেই গত শুক্রবার রাত ২টা ৪২ মিনিটে তার অফিসের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। এরপর একে একে বিচ্ছিন্ন করা হয় ডিশ লাইন, ইন্টারনেট ও টেলিফোন সংযোগ। তারপর মোবাইল নেটওয়ার্কও বন্ধ করা হয় তার অফিস ও সংলগ্ন এলাকায়। তবে প্রায় ২০ ঘণ্টা পর শনিবার রাতেই পুনরায় বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়।
সোমবার রাত পর্যন্ত ডিশ লাইন, ইন্টারনেট ও টেলিফোন সংযোগ সংযোগ দেওয়া হয়নি।
এদিকে সোমবার সকাল থেকে বিএনপি চেয়ারপারসনের অফিস ঘিরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বেড়েছে। চাইলেই যে কাউকে সেখানে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না গোয়েন্দা পুলিশ। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ ও কার্যালয়ের উত্তর দিকে কিছু মহিলা পুলিশও দেখা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এক কর্মকর্তা বলেন, ‘খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে প্রবেশে কোনো বাধা নেই। কেউ যদি প্রবেশ করতে চায় তাহলে কার্যালয়ের ভিতর থেকে অনুমতি নিতে হয়। তবে কেউ প্রবেশ করলে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাই। তারা নির্দেশ দিলেই কেবল কাউকে আটক করা হয়।’
এর মধ্যে গত শনিবার রাত ৮টা ১০ মিনিট থেকে ৯টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত মোমবাতির আলোতে বাইরের অতিথিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন খালেদা জিয়া। দীর্ঘ ৯০ মিনিট মোমবাতির আলোতে তিনি অনেকটা ব্যস্ত সময় পার করেন।
গত ৩ জানুয়ারি (শনিবার) রাত সাড়ে আটটার দিকে খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ে আসেন। সেখানে দলের কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলেন তিনি। পরে দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর অসুস্থ হওয়ার খবর জানতে পারেন। তাকে দেখার জন্য নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যেতে চান খালেদা জিয়া। ওই রাতেই সাড়ে ১১টার দিকে খালেদা জিয়া নয়াপল্টনে যেতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। পরে কিছুক্ষণ গাড়িতে অপেক্ষা করে ফের কার্যালয়ের দোতলায় যান তিনি।
এরপর সেখানেই ওই রাত কাটান তিনি। পরদিন কার্যালয়ে প্রধান ফটকে ঝোলানো হয় তালা। মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। গুলশানের ৮৬ নম্বর সড়কে এই কার্যালয় ঘিরে পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। সড়কের দুই মাথায় বসানো হয় দুটি তল্লাশি চৌকি। ওই সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। কার্যালয়ের পাশেই বড় আকারের দুটো গাড়ি আড়াআড়িভাবে রেখে বের হওয়ার পথও আটকে দেওয়া হয়। র্যাব, পুলিশের সাঁজোয়া যানও প্রস্তুত ছিল। শুরু থেকে কার্যালয়ের বাইরে রাস্তায় মোট ১৩টি বালু ও ইটের ট্রাক দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে সেগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়।
সর্বশেষ অফিসের সামনের রাস্তায় পুলিশের দুটি পিকআপ ও একটি জলকামান আড়াআড়িভাবে রাখা হয়। ১৮ জানুয়ারি গভীর রাতে সেগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর থেকে খালেদা জিয়ার নিজস্ব নিরাপত্তা সিকিউরিটি নিয়ে অফিসে অবস্থান করছেন। এ সময়ের মধ্যে দলের নেতাকর্মী ছাড়াও আত্মীয় স্বজনরা মাঝে মাঝে খাবার নিয়ে আসেন। অবরোধ পরিস্থিতি অফিসে বসেই সারাদেশের আন্দোলন সরাসরি মনিটরিং করেন তিনি।
অফিসে অবস্থানকালে গত ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ উপলক্ষে গুলশান কার্যালয় বের হওয়ার চেষ্টা করেন খালেদা জিয়া। মহিলা দলের নেতাকর্মীরা গেট খুলে দেওয়ার দাবিতে শ্লোগান দিলে দুই দফা পেপার স্প্রে করে পুলিশ। পরে খালেদা জিয়া প্রায় ৪৫ মিনিট পর গাড়ি থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন এবং অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দেন তিনি।
গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার সঙেগ রয়েছেন—দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল কাইয়ুম, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, মাহবুব আলম ডিউ, নিরাপত্তা সমন্বয়কারী কর্ণেল (অব:) আব্দুল মজিদ, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, প্রেস উইংয়ের সদস্য শামসুদ্দিন দিদার, শায়রুল কবির খান। এছাড়াও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় নিয়োজিত সিএসএফ সদস্য ও অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান জানিয়েছেন, ‘কার্যালয়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় আমরা সব ধরনের যোগাযোগ থেকে একরম বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি। খবরাখবর আহরনে আমাদের একমাত্র মাধ্যম এখন পত্রপত্রিকা। ম্যাডাম (খালেদা জিয়া জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো পড়েন।’
তিনি জানান, ‘ম্যাডামের দুই নাতনি জাফিয়া ও জাহিয়া দাদীর সঙ্গে মাঝে মাঝে সময় কাটাচ্ছেন। রাতে তারা দাদীর সঙ্গে ঘুমাচ্ছে। সকাল-বিকালে পালাক্রমে কোকোর স্ত্রী শামিলা রহমান সিথি, দুই ভাইয়ের স্ত্রীর নাসরিন সাঈদ ও কানিজ ফাতেমা পালাক্রমে গুলশানের কার্যালয়ে এসে কথা বলছেন।’
খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ে থাকা অবস্থায় গত ২৪ জানুয়ারি (শনিবার) মালয়েশিয়ায় বসবাসরত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রে উইংয়ের সদস্য শামসুদ্দিন দিদার বলেন, ‘ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলার ৩০ দিন পার হয়ে গেল।’
তিনি জানান, ‘শুক্রবার দিবাগত রাতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এর পর শনিবার ভোর থেকেই ডিশ, ইন্টারনেট, টেলিফোনসহ সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। আমরা মোবাইলে ঠিকমতো নেটওয়ার্ক পাচ্ছি না।’
ডিশ বিচ্ছিন্ন থাকায় ম্যাডাম টেলিভিশনে কোনো খবর দেখতে পান না। তবে ম্যাডাম পত্রিকা পড়ে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুটা অবহিত হন বলেও জানান তিনি।
চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের অপর এক সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, ‘গত শুক্রবার রাত থেকে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পর্যায়ক্রমে ডিশ লাইন, ইন্টারনেট ও টেলিফোন লাইনের সংযোগও কেটে দেওয়া হয়। আজ (সোমবার) পর্যন্ত গুলশান কার্যালয়ের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া তথ্য-যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো পুনঃস্থাপিত হয়নি।’
তিনি জানান, মোবাইল নেটওয়ার্ক, টিএন্ডটি টেলিফোন, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট ব্রডব্যন্ড ইত্যাদি যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধ হয়ে আছে। টেলিভিশনের ক্যাবেল লাইনও কেটে দেওয়া হয়। অফিস থেকে যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধ থাকায় কর্মকর্তারও দাফতরিক কাজ করে সময় পার করছেন।