রাজনীতি আর পদোন্নতি নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রশাসনে
দেশে চলমান সহিংস ঘটনাবলিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার রেশ রয়েছে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়েও। প্রতিদিনের নাশকতায় প্রাণহানি আর দগ্ধ করার ঘটনায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিচলিত। নিরাপদে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত তাঁরা ভোগেন নিরাপত্তাহীনতায়। পাশাপাশি প্রশাসনে এক ধরনের চাপা উত্তাপ আছে সম্ভাব্য পদোন্নতি ঘিরেও। উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে চলতি মাসের মাঝামাঝি পদোন্নতি দেওয়া হতে পারে। এ নিয়ে ফের বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কাও কাজ করছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশের মধ্যে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় প্রশাসনের সর্বাত্মক সহায়তা পেয়েছে সরকার। এর জন্য সরকারের মন্ত্রীরা নানাভাবে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন সময়। কিন্তু নতুন সরকার গঠনের পর অনেকেই সুবিচার পাননি বলে অভিযোগ করে আসছেন।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে একটি স্টাফ বাস গত ১৫ জানুয়ারি সচিবালয় থেকে সাভারের পথে রওনা হয়েছিল। তবে টেকনিক্যাল মোড়ে গিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নেমে যেতে বলা হয় হরতাল-অবরোধে গাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায়। বাধ্য হয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে যেভাবে পেরেছেন গন্তব্যে গেছেন। তাঁদেরই একজন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের জীবনের চেয়ে কি গাড়ি বেশি মূল্যবান?’
এমন নিরাপত্তাহীনতা কাজ করছে সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যেই। কারণ সরকারি গাড়িগুলোয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নাম লেখা থাকে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের গাড়িতে থাকে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড। এসব দেখে হরতাল-অবরোধকারীরা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে হামলা চালায়। নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, সাভার, ধামরাই, জয়দেবপুরের মতো দূরের স্টাফদের আনা-নেওয়া করে ৬১টি বাস। পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ থাকলে গাড়ি বের করা হয় না, কিন্তু কর্মচারীদের অফিস করা বাধ্যতামূলক। বরং হরতালের দিন হাজিরার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ বেশি কঠোর থাকে। সরকারি কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক কানিজ ফাতেমা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। কর্মচারীদের অফিসে আনা-নেওয়ার দায়িত্ব যেমন আছে, তেমনি গাড়িগুলো রক্ষার বিষয়ও আছে। একটা গাড়ি ভাঙচুরের শিকার হোক, তা আমরা চাই না।’
যাতায়াতের দুশ্চিন্তার পাশাপাশি সরকারি চাকরিজীবীদের একটি বড় সময় কাটে দেশের চলতি পরিস্থিতিবিষয়ক আলোচনায়। কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের এক নন-ক্যাডার কর্মকর্তা আলাপ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি প্রতিদিন অফিসে আসার সময় ছেলেমেয়েদের বলি, যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে আর নাও ফিরতে পারি। যেকোনো সময় পেট্রলবোমা আমার ওপরও এসে পড়তে পারে। এসব কথা বললে ওদের মনও খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু কী করব বলুন। সে দিন চোখের সামনে দেখলাম একজনকে দগ্ধ হতে। যেকোনো সময় আমার অবস্থাও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল কাদির মিয়ার মতো হতে পারে।’
চলমান অবরোধ কর্মসূচিতে কর্তব্যরত অবস্থায় ককটেল বিস্ফোরণের শিকার হন ফেনীর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল কাদির মিয়া। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ভারতে পাঠানো হয়েছে। ককটেলের আঘাতে তাঁর বাঁ চোখের মণি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁ কানেও শুনতে সমস্যা হচ্ছে। সারা মুখে তাঁর ক্ষত। কাদিরের উন্নত চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এ সংখ্যা বাড়তে থাকলে কতজনের দায়িত্ব নেবে সরকার? গত ৯ জানুয়ারি ফেনীতে দায়িত্ব পালনরত তিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়িতে ককটেল হামলা হয়। এতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল কাদির মিয়া ও মো. রাশেদুর রহমান আহত হন। রাশেদ প্রাথমিক চিকিৎসার পরই সুস্থ হয়ে ওঠেন। মাইক্রোবাসে থাকা অন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শিহাব উদ্দিন আহমদ অক্ষত ছিলেন।
রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে আসন্ন পদোন্নতির বিষয়টিও প্রশাসনে উৎকণ্ঠা ছড়াচ্ছে। গত ছয় বছরে প্রতিবারই এ ক্ষেত্রে বঞ্চনার ঘটনা রয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী রিভিউ করার নির্দেশ দিলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। ফলে প্রশাসনে চাপা ক্ষোভ রয়েই গেছে। পদোন্নতি পেতে ব্যর্থ কর্মকর্তারা অপেক্ষায় ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক বা নতুন কোনো সরকারের। তবে তা না হওয়ায় তাঁরা হতোদ্যম হয়েছেন। আওয়ামী লীগ গত বছরের ১২ জানুয়ারি নতুন সরকার গঠন করার পর বঞ্চিত অনেক কর্মকর্তা প্রশাসনে ক্ষমতাসীন দলের দাপুটে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানেও খুব ফলদায়ক কিছু ঘটেনি। কারণ ক্ষমতাসীন দলপন্থী কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভাজন থাকায় তাঁদের পদোন্নতি বা ভালো পদে পদায়ন করা সম্ভব হয়নি। এবার পদোন্নতির উদ্যোগ নেওয়ার পর বঞ্চিত এসব কর্মকর্তা নতুন করে আশায় বুক বেঁধেছেন।
পদোন্নতির বিষয়ে গত সপ্তাহে বৈঠক করেছে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি)।
শূন্য পদ না থাকার পরও বোর্ডকে তিন স্তরে পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করতে হচ্ছে। প্রশাসন ক্যাডারে বর্তমানে প্রায় পাঁচ হাজার কর্মকর্তা রয়েছেন। এর মধ্যে উপসচিব পদ হচ্ছে ৮৩০টি, কিন্তু বর্তমানে রয়েছেন এক হাজার ২৮৩ জন। যুগ্ম সচিবের পদ ৪৩০টি, কর্মরত আছেন ৮৭৫ জন। অতিরিক্ত সচিবের ১০৭টি পদের বিপরীতে আছেন ২৪২ জন। এর মধ্যে ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগের ব্যাচের বঞ্চিত কর্মকর্তারাও বিবেচনায় আসবেন। যুগ্ম ও অতিরিক্ত সচিব পদের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা।
সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের প্রধান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা কালের কণ্ঠকে বলেন, উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এসএসবির কয়েকটি বৈঠকও হয়েছে। সুপারিশ চূড়ান্ত করতে আরো কয়েকটি বৈঠক করতে হবে। ফেব্রুয়ারি মাসে এ পদোন্নতি হতে পারে। তিন স্তরের পদোন্নতি নিয়ে প্রশাসনে ব্যাপক তদবির শুরু হয়েছে। এতে শামিল হয়েছেন মন্ত্রী, উপদেষ্টা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। সরকারি চাকরি বিধানে এমপিদের তদবির চাকরি বিধির পরিপন্থী হলেও অনেক কর্মকর্তা তাঁদের দিয়ে তদবির করাচ্ছেন। জনপ্রশাসন সচিবের কাছে ১৯৮৪ ব্যাচের এক কর্মকর্তা লিখিতভাবে পদোন্নতি চেয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, ২০০৯ সালে থেকে যুগ্ম সচিব পদে কাজ করছেন তিনি। ২০১২ সালে ১২৭ জনকে অতিরিক্ত সচিব করা হলেও তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে আবার ৮০ জনকে অতিরিক্ত সচিব করা হলেও তিনি বাদ যান। অথচ মেধা তালিকায় তাঁর নিচে থেকেও ৩০ জন কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করেছেন।