অচলাবস্থায় সরকারের আন্তর্জাতিক অঙ্ক
বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, জনজীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক চাপ সামলাতে কঠিন সময় পার করছে সরকার। আন্তর্জাতিক অঙ্কে কৌশলের হেরফের হলে বাংলাদেশকে চড়া মূল্য গুনতে হবে।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকলে সন্ত্রবাসবাদ বা জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিতে পারবে না— পশ্চিমারা এখনো এ বিষয়ে আস্থাশীল। অন্যদিকে, নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে পূর্বের দেশগুলোও সরকারের প্রতি আস্থাশীল। কিন্তু বর্তমান অস্বাভাবিক আর অচলাবস্থার উন্নতি না হলে সরকারের ওপর থেকে পশ্চিমাসহ সারাবিশ্বের আস্থা পরিণত হবে অনাস্থায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কূটনীতিক এবং ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে আলাপ করে এমন আভাস মিলেছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার জাতীয় সংসদে বলেন, ‘জরুরি অবস্থা জারির মতো কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। দেশের প্রচলিত আইনেই নাশকতা দমন সম্ভব।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানান, সরকার কোনো প্রকার আন্তর্জাতিক চাপ অনুভব করছে না। এই সরকারের ওপর বিশ্ব সম্প্রদায়ের আস্থা রয়েছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘ঢাকায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক মিশনগুলোকে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। কারা নাশকতা করছে, তাদের কাছে তা পরিষ্কার।’
একাধিক কূটনীতিকের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সামলানোর অঙ্কে সরকার এখনো স্পর্শকাতর অবস্থানে রয়েছে। হিসাবে ভুল হলেই সরকারকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হবে।
বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্যতম সহায়তাকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে যে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকলে জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিতে পারবে না। আর বিশ্বব্যাপী জঙ্গীবাদ নির্মূলে যুদ্ধে নেমেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির বাজেটেও এ বিষয়ে বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে এবং বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে যুক্তরাষ্ট্রের এই আস্থা অনাস্থায় পরিণত হতে সময় লাগবে না।
এরই মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র নিন্দা এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র পরিচালক ফিল র্যাইনার জানান, বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। কেননা, দেশটি বিশ্বাস করে বিএনপি ক্ষমতায় এলে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে। অবস্থার উন্নতি না হলে তারা পদক্ষেপ নেবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে তৃতীয় শক্তির উদয় হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পরিস্থিতির যদি উন্নতি না হয় তবে তখন তৃতীয় শক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করতে পারে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র একবার আস্থাহীন হলে পশ্চিমা বিশ্বের সব দেশই তাদের পথে হাঁটবে।’
কূটনীতিকরা বলছেন, বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারতের সু-সম্পর্ক বিরাজ করছে। ভারতের সেভেন সিস্টারের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোকে দমনে সহায়তা করছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে বাংলাদেশের সড়ক ব্যবহার করে খাদ্যসামগ্রী পাঠাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশের প্রতি ভারত ইতিবাচক। আবার ভারতও মনে করে, বিএনপি সরকার এলে ভারতের সেভেন সিস্টারে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মাথাচাড়া দিতে পারে।
এরই মধ্যে ভারত জানিয়েছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।
পূর্বের দেশ চীন ও জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সু-সম্পর্ক বিরাজ করছে। দুই দেশের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের সফর হয়েছে। দুই দেশই বাংলাদেশকে যে কোনো সময়ের চেয়ে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ সহায়তা করছে।
কূটনীতিকদের মতে, বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে জাপান কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতেই জাপানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করছেন। এ থেকেই জাপানোর মনোভাব বোঝা যায়।
অন্যদিকে, চীন বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি কিছুই বলবে না। কেননা চীন সরকারের প্রতিই অভিযোগ রয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘তিব্বত এবং তাইওয়ানের ক্ষেত্রে চীনের নেওয়া একক নীতির প্রতি বাংলাদেশের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। কেউ কারও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না— এই নীতির ওপর দুই দেশের দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।’
চীনের পক্ষে ঢাকায় নিযুক্ত নতুন রাষ্ট্রদূত মা মিংজেঙ বলেন, ‘বাংলাদেশ চীনের দীর্ঘদিনের বন্ধু। দুই দেশ কয়েক দশক আগে থেকেই নিজেদের উন্নয়নে একে অপরকে সহায়তা করছে। সামনের দিনগুলোতে এ সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে।’
এদিকে, আরব বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমবাজার দীর্ঘ ছয় বছর বন্ধ থাকার পর বর্তমান অচলাবস্থার মধ্যেই চলতি সপ্তাহে আবার চালু হয়েছে। আরব বিশ্বের সরকারি প্রতিনিধিরাও সামনের সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরে আসছেন। এই চিত্র থেকেই সরকারের সঙ্গে আরব বিশ্বের যোগাযোগ বোঝা যায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, বৈশ্বিক আস্থা বজায় রাখতে প্রতিনিয়ত বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের জানানো হচ্ছে। দেশের বাইরে অবস্থিত বাংলাদেশের মিশনগুলোকেও এ বিষয়ে যথাযথ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।