কার্যত ঢাকা বিচ্ছিন্ন
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধে আশপাশের কয়েকটি ছাড়া বাকি সব জেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে রাজধানীর ঢাকার। সরকার ও প্রশাসন থেকে আশ্বাস দিলেও দূরপাল্লার পরিবহন ছাড়তে রাজি হচ্ছেন না অধিকাংশ পরিবহন মালিক। পুলিশি পাহারায় কয়েকটি দূরপাল্লার পরিবহন চলাচল করলেও মঙ্গলবার কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে নৈশকোচে ঘটে যাওয়া নাশকতার পর নিরাপত্তার ভরসা পাচ্ছেন না মালিকপক্ষ।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে রাজধানী কার্যত বিচ্ছিন্ন রয়েছে বলে মনে করছেন যোগাযোগ ব্যবস্থা সংশ্লিষ্টরা। দীর্ঘ ৩০ দিনের এই যোগাযোগ অচলাবস্থা দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন তারা। রাজধানী দেশের সকল প্রশাসনিক কাজের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকাটা জাতীয় উন্নয়ন ও সার্বিক অর্থনীতির জন্য ভাল কিছু হবে না বলে মত দিয়েছেন তারা।
পরিবহন মালিক সমিতির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীর আশপাশের তথা গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী জেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ স্বাভাবিক রয়েছে। এ সব জেলা থেকে যাত্রী ও পণ্যবাহী পরিবহন ঢাকাতে প্রবেশ করছে। তবে বাকি জেলাগুলোর সঙ্গে এই ৩০ দিনের অবরোধে দূরপাল্লার ৯০ শতাংশ যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
তড়িৎ কৌশল প্রকৌশলী ইব্রাহিম কবীর রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। গ্রামের বাড়ি খুলনার ফুলতলা থেকে অসুস্থ বাবাকে ঢাকা আনতে পারছেন না চিকিৎসার জন্য। অবরোধের কারণে তিনিও খুলনা যেতে ভয় পাচ্ছেন। তার আশঙ্কা যদি রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে। গত সপ্তাহে একবার গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন, তবে সরাসরি কোনো যানবাহনে না। ঢাকা থেকে মুন্সীগঞ্জের বাসে করে মাওয়া ফেরিঘাট পর্যন্ত যান ইব্রাহিম। তারপর সেখান থেকে স্পিডবোটে নদী পার হয়ে প্রথমে মোটরবাইকে করে পৌঁছান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। তারপর সেখান থেকে টেম্পোতে যান বাগেরহাটে। আবার সেখান থেকে মোটরবাইকে করে খুলনা পৌঁছান তিনি। ঢাকায় ফেরার কৌশলটাও একই ছিল ইব্রাহিমের।
তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমার আব্বা অসুস্থ বেশ কয়েক বছর ধরে। তাকে গত বছর ভারতে নিয়ে যাই। সেখানে চেন্নাইয়ের এ্যাপোলো হাসপাতালে তার চিকিৎসা করানো হয়। পরে সেখান থেকে আমাদের বলে দেওয়া হয় প্রতি ছয় মাস পরপর ঢাকার বনানীতে এ্যাপোলো হাসপাতালের একটি সেন্টারে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে (ভারতের চিকিৎসক) যোগাযোগ করতে হবে। কিন্তু টানা অবরোধে আব্বাকে ঢাকায় আনতে পারছি না।’
রাজধানীর মিরপুর-১০ কাঁচাবাজারের চাল আড়ৎ মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি আবদুর রহিমের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘উত্তরবঙ্গ ও কুষ্টিয়া থেকে কোনো চালের ট্রাক রাজধানীতে আসছে না। সাধারণত প্রতিটি রাইস মিলেরই নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা থাকে। তাদের ট্রাকে করেই ঢাকায় আমরা চাল আনি। কিন্তু এখন রাইস মিল মালিকরা তাদের ট্রাকে চাল পাঠাতে চাচ্ছেন না। তারা আমাদের বিকল্প পরিবহনের মাধ্যমে চাল নিতে বলছেন।’
তিনি বলেন, ‘শুক্র ও শনিবার অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে আমরা চাল আনছি। তাও চাহিদা অনুযায়ী পারছি না। এখনই চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এরপর রাজধানীর চাহিদা অনুযায়ী চাল সরবরাহ করতে পারব কিনা সন্দেহ আছে।’
ফকিরাপুলের মুরগি ব্যবসায়ী মো. মুজিবুর রহমান বাচ্চু প্রতিদিন উত্তরবঙ্গের খামারির কাছ থেকে মুরগি কিনে এনে তা রাজধানীতে পাইকারি বিক্রি করেন। বাচ্চুর সঙ্গে কথা হলে তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘৩০ দিনের টানা অবরোধে আমার ছয় লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। প্রতিদিন বগুড়া থেকে এক পিকআপ মুরগি (আড়াই হাজার) ঢাকায় আনি। রাতে মুরগি ঢাকায় পৌঁছলেও পরদিন সকাল ৮টার মধ্যে সব মুরগি বিক্রি হয়ে যেত। কিন্তু টানা অবরোধে তিন দিনেও মুরগি বিক্রি করতে পারছি না।’
তিনি আরও জানান, এরই মধ্যে মুরগি পরিবহনে ব্যবহৃত তার নিজস্ব পিকআপটিও হরতালে নাশকতার শিকার হয়েছে। পিকআপটির সামনের গ্লাস ভেঙে দিয়েছে পিকেটাররা।
বাচ্চু বলেন, ‘মুরগির ব্যবসার পাশাপাশি অন্য ব্যবসা থাকায় এখনো বেঁচে আছি। লস (ক্ষতি) হচ্ছে জেনেও মুরগির ব্যবসা আমাকে চালিয়ে যেতে হচ্ছে। কারণ আমার এ ব্যবসার সঙ্গে আরও প্রায় ১৫ জন স্টাফ রয়েছে। আমি যদি এখন ব্যবসা বন্ধ রাখি তাহলে তারা বেকার হয়ে যাবে। তবে এভাবে অবরোধ চলতে থাকলে বাধ্য হয়ে ব্যবসা বন্ধ রাখতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে হানিফ এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক মো. তোফাজ্জল হোসেন রিপন বলেন, ‘টানা অবরোধে গত ৩০ দিনে আমাদের তেমন কোনো গাড়ি চলাচল করেনি। আমাদের কোম্পানিতে এসি ও ননএসি মিলিয়ে সবসময় চারশ’ গাড়ি চলাচল করে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার রুটে ২০টি ভলভো বাস চলাচল করে। অবরোধের শুরু থেকে একটিও ভলভো গাড়ি ছাড়া হয়নি। এ ছাড়া দেশের সব অঞ্চলে ননএসি প্রায় ৩৮০টি বাস চলাচল করে। কিন্তু অবরোধে উত্তরবঙ্গের কোনো রুটে গাড়ি চলাচল করছে না। শুধু সিলেট, খুলনা ও বরিশাল রুটে ৫০টির মতো গাড়ি চলাচল করছে। এখন পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হচ্ছে যে— যেগুলো চলত সেগুলোও বন্ধ করে দিতে হবে।’
রিপন বলেন, ‘গত মঙ্গলবার কক্সবাজার-ঢাকা রুটের একটা বাসে যেভাবে পেট্রোলবোমা মেরে আগুন দেওয়া হয়েছে তারপর কোনো মালিক রিস্ক (ঝুঁকি) নিয়ে বাস রাস্তায় নামাবেন না। যদিও নামায় তাহলে যাত্রী পাওয়া যাবে না।’
মহাসড়কে প্রশাসনের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে রিপন বলেন, ‘সরকার অনেক কথাই বলে; গাড়ি ভাংচুর হলে ক্ষতিপূরণ দিবে। আমরা ক্ষতিপূরণ চাই না। আমরা চাই রাস্তার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক। আর আমাদের কোম্পানির মোট বাসের সংখ্যা প্রায় চারশ’।
এখন সরকার কি পারবে প্রতিটি গাড়ির সঙ্গে পুলিশ পাহারা দিতে? এভাবে কি প্রতিটা কোম্পানির গাড়ির নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব?’
রাজধানীর সঙ্গে অন্যান্য জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এখন ঢাকা থেকে দূরপাল্লার অধিকাংশ বাস ছেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা মোটামুটি শতভাগই স্বাভাবিক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় মহাসড়ক এখন স্বাভাবিক হয়েছে।’
চৌদ্দগ্রামের নাশকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এ ধরনের ঘটনাকে বিবেচনা করে বলা যায় না যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল রয়েছে। এ ধরনের নাশকতাও খুব শিগগিরই দমন করবে সরকার— এ আশা করি।’
বাস মালিকদের ভাষ্য অনুযায়ী পরিবহন ব্যবস্থা এখন অচল— এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘যদি কোনো মালিক তার গাড়ি না চালাতে চান তাহলে সরকার কি তাকে বাধ্য করতে পারবে। তবে আমার জানা মতে সবাই ব্যবসায়ী। ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ তার ব্যবসা বন্ধ রাখবে না।’
বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘টানা অবরোধে দেশের পণ্য পরিবহনের কাজে যে সব যানবাহন ব্যবহার করা হয় তার প্রায় ৯০ শতাংশই বন্ধ রয়েছে। গত ৩০ দিনে এই খাত পুরো ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে সরকারকে এই খাতে সাবসিডি দিতে হবে। ঢাকার আশপাশের কয়েকটি জেলায় মাত্র ১০ শতাংশ গাড়ি চলাচল করলেও তা দূরপাল্লার না।’
তিনি বলেন, ‘অন্য মালিকদের কথা বলতে পারব না, আমার যে কয়টা ট্রাক আছে সেগুলো কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো থেকে ঢাকায় পণ্য পরিবহন করে। কিন্তু গত এক মাসে একটা ট্রাকও ভাড়া হয়নি। কয়েকজন যোগাযোগ করলেও নিরাপত্তার কথা ভেবে রাস্তায় ট্রাক নামাতে পারছি না।’
দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলা হলে ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের এ্যাডভোকেসি অফিসার ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ মো. মাহরুফ রহমান বলেন, ‘একটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি প্রত্যক্ষভাবে নির্ভর করে ওই দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর। সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দিতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে ওইভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি, যা আছে তা নিয়ে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের সব সময় অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এখন টানা অবরোধ দেশের অর্থনীতির জন্য গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
মাহরুফ রহমান বলেন, ‘ঢাকা হচ্ছে দেশের প্রাণকেন্দ্র। সকল সরকারি, বেসরকারি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় ঢাকায়, যা বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায় না। দেশের রফতানি খাতের প্রধান পোশাকশিল্পের অধিকাংশ কারখানা রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায়। কিন্তু রফতানি প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এখন টানা অবরোধে যেভাবে রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে, তাতে রফতানিমুখী সকল খাতের ওপর প্রভাব পড়বে। আর অর্থনৈতিক এই ক্ষতি দেশকে ভবিষ্যতে অনেক ভোগাবে।’