যে কারণে মাঠে নেই মহানগর বিএনপি
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ ও হরতাল চললেও রাজধানীতে নামতে পারেনি ঢাকা মহানগর বিএনপি। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের নেতাকর্মীরা দলীয় কর্মসূচির সমর্থনে বিক্ষিপ্ত মিছিলের পাশাপাশি পিকেটিং করার চেষ্টা করলেও রাজধানী ঢাকার অবস্থা ব্যতিক্রম।
জানা গেছে, ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন কমিটিতে সাবেক আহ্বায়কের অনুসারী না রাখার গুঞ্জন, সিটি করপোরেশনের সাবেক কমিশনার হলেও তাকে বাদের গুজব, নতুন কমিটিতে বিগত সংসদ নির্বাচনে দলীয় সংসদ সদস্য প্রার্থী ও তাদের অনুসারীদের প্রাধান্য, ত্যাগী নেতাদের স্থান না হওয়ার অভিযোগে মাঠে নামছে না ঢাকা মহানগর বিএনপি। এ ছাড়াও ঢাকা মহানগর বিএনপি দায়িত্ব নেওয়ার পর দীর্ঘদিন পার হলেও নতুন কমিটি আলোর মুখ না দেখাসহ নানা কারণে সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে নেই নগরের নেতাকর্মীরা।
তবে নেতাকর্মীদের নিষ্ক্রিয় থাকার কথা অস্বীকার করেছেন ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল।
গণতন্ত্র ‘পুনরুদ্ধার’ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এ বছরে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে লাগাতার কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। আন্দোলনের প্রথম ১৩ দিন গুলশানে নিজ রাজনৈতিক কার্যালয়ে ‘অবরুদ্ধ’ অবস্থায় কাটিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এরপর তার কার্যালয় এলাকা থেকে পুলিশি ব্যারিকেড উঠিয়ে নেওয়া হলেও নিজ কার্যালয়ে স্বেচ্ছা অবস্থান নিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। সেখান থেকেই তিনি কর্মসূচি ঘোষণা করছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের আহ্বানে সারা দেশের নেতাকর্মীরা সাড়া দিলেও রাজধানী ঢাকাতে এখনও পর্যন্ত আন্দোলন আশানুরূপ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেনি বিএনপি নেতাকর্মীরা। প্রতিদিন বিচ্ছিন্ন ও ‘কিছু সহিংস’ কর্মকাণ্ড ছাড়া এখনো রাজপথে দেখা যায়নি দলটির নেতাকর্মীদের।
তবে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল বলেন, ‘ঢাকা মহানগরের হাজার হাজার নেতাকর্মী চলমান শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় রয়েছেন। যার যার অবস্থান থেকে তারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করছেন। মহানগরে এখনো কোনো কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। তাই ভুল বোঝাবুঝির কোনো সুযোগও নেই। আন্দোলনে ত্যাগ ও দলীয় আনুগত্য এবং সাংগঠনিক দক্ষতা দেখেই কমিটিতে প্রকৃত নেতাকর্মীদের স্থান দেওয়া হবে।’
গত বছরের ১৪ জুলাই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক ও দলের অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেলকে সদস্য সচিব করে ৫১ সদস্যের ঢাকা মহানগর কমিটি ঘোষণা করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আন্দোলনে ‘নিষ্ক্রিয়’ থাকার অভিযোগে নতুন এ কমিটি ঘোষণার মধ্যদিয়ে বাদ পড়েন দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করা বিএনপির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা। খোকা দীর্ঘ ১৭ বছর মহানগর বিএনপির নেতৃত্বে ছিলেন।
দীর্ঘদিন ‘নিষ্ক্রিয়’ থাকা ঢাকা মহানগর বিএনপিকে আন্দোলনের ধারায় ফেরাতে মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে দলের স্থায়ী কমিটি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম-মহাসচিবের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক দলের তরুণ নেতৃত্ব সোহেলকে সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেয় দলের হাইকমান্ড। শুরুতে মির্জা আব্বাসসহ দলের সিনিয়র নেতারা সোহেলের মতো অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্বকে নিয়ে কাজ করার বিষয়ে দ্বিধায় ভুগতে থাকেন। সে জন্য অচলাবস্থাও দেখা দেয়। সেই অচলাবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে সিনিয়র নেতাদের নিয়ে একাধিকবার বৈঠক করেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ধীরে ধীরে এ অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠে মহানগর বিএনপি। শুরু হয় মহানগরের বিভিন্ন কমিটি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। একেক থানা, ওয়ার্ড কমিটি গঠনে দায়িত্ব দেওয়া হয় আহ্বায়ক কমিটির বিভিন্ন সদস্যদের। কেউ কেউ সরেজমিন গিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে বৈঠক, সম্মেলন করে কমিটি গঠনের কাজে হাত দেন। অনেকে নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অথবা সুবিধামতো স্থানে সংশ্লিষ্ট এলাকার নেতাদের ডেকে নিয়ে কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেন। এ সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাকর্মীরা একাধিকবার নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়েন। অবশ্য এ সব সংঘর্ষের ঘটনার পেছনে সরকারের ইন্ধন আছে বলে তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা গণমাধ্যমে অভিযোগও করেন।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন সংঘর্ষের ঘটনার মধ্যেও কমিটি পুনর্গঠনের কাজ ধীরে এগিয়ে চলার সময়েই গত ৫ জানুয়ারি থেকে ‘কঠিন ও কঠোর’ আন্দোলনের চ্যালেঞ্জে পড়ে বিএনপি। ঘোষিত হয় দেশব্যাপী টানা অবরোধ-হরতালের মতো কর্মসূচি। আন্দোলন মোকাবিলায় সরকারও হার্ডলাইনে যায়। শুরু হয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, রিমান্ডসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ।
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রীতিমতো আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হন মহানগর আহ্বায়ক, সদস্য সচিবসহ অন্য সিনিয়র নেতারা। এ ছাড়া অনেকেই ইতোমধ্যে গ্রেফতারের শিকারও হয়েছেন।
মহানগর সূত্র জানায়, চলমান আন্দোলনে বিএনপির দীর্ঘ সময় ধরে মহানগর কমিটির আলোচিত নেতারা সক্রিয় হননি। অনেকেই গ্রেফতার এড়াতে গোপন স্থানে চলে গেছেন। প্রায় সব নেতাই মোবাইল ফোন বন্ধ রেখেছেন। তাদের খোঁজ পাচ্ছেন না দলের সাধারণ কর্মীরাও। চলমান আন্দোলনে ঢাকা মহানগরে যতটুকু তৎপরতা চোখে পড়ে, তার সিংহভাগই করছেন সাধারণ তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তারা সিনিয়র নেতাদের সহযোগিতাও পাচ্ছেন না।
সূত্র জানায়, আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস ও সদস্য সচিব হাবিব উন নবী সোহেল বর্তমানে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন নেতাকর্মীদের আন্দোলনমুখী করতে। কিন্তু বিভিন্ন থানা কমিটিতে ‘খোকা-সালাম কমিটির কেউ স্থান পাচ্ছে না’— এমন প্রচারণার কারণেই এ আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন নেতারা। নেতাদের নিষ্ক্রিয়তায় তাদের হাজার হাজার অনুসারীও হাত গুটিয়ে রয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন থানা কমিটির নেতৃত্ব ‘অমুক’কে দেওয়া হচ্ছে— এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ায়ও অনেক সক্রিয় নেতাকর্মী নীরব থাকছেন। মূল্যায়ন না পাওয়ার আশঙ্কায় অনেক সক্রিয় নেতাকর্মী নতুন করে ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। তারা কেবল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় কমিটি নেই দীর্ঘ প্রায় ৯ বছর। সেখানে সাবেক কমিশনার আতিকুল ইসলাম মতিন নিজের চেষ্টা, শ্রম ও অর্থ খরচ করে দলীয় নেতাকর্মীদের আগলে রেখেছেন। অথচ গুঞ্জন রটেছে মোহাম্মদপুর থানা কমিটিতে মতিনকে রাখা হচ্ছে না। কারণ মোহাম্মদপুর সংসদীয় আসনে বিএনপির নমিনি হলেন যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।
আলালের সঙ্গে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণে মতিনকে বাদ দিয়ে সেখান আলালের অনুসারী কাউকে থানা কমিটির নেতৃত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ গুঞ্জন চাউর হলে মতিন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। আগের মতো আন্দোলনে তার অনুসারীরা মাঠে নামছেন না।
মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব উন নবী সোহেল বলেন, ‘বর্তমান অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট সরকার বিএনপির মতো দেশের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলকে কোনো গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করতে দিচ্ছে না। আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী শান্তিপূর্ণভাবে খালি হাতে রাজপথে নামলেও ভয়ে তারা দলীয় আনুগত্যকারী সরকারি প্রশাসনকে দিয়ে হামলা চালাচ্ছে, গুলি করে নেতাকর্মীদের হত্যা করছে। অনেককে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যার পর ক্রসফায়ারের নাটক সাজানো হচ্ছে। গুম করা হচ্ছে। এ ছাড়া গণগ্রেফতার তো রয়েছেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচি চালাতে বাধা দিলে ঢাকার রাজপথ মুহূর্তেই লাখ লাখ নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের পদভারে প্রকম্পিত হবে। জনতার জোয়ারকে কেউ বাঁধ দিয়ে আটকে রাখতে পারবে না।’