রাজনৈতিক অস্থিরতায় এলোমেলো শিক্ষা ব্যবস্থা
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় এলোমেলো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায়। হরতাল-অবরোধের কারণে এসএসসি ও সমমানের দুটি পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার প্রথম পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও হরতালের কারণে রবিবারের পরীক্ষা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদ, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা।
রাজনৈতিক অস্থিরতায় শুধু এসএসসি পরীক্ষা না, চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে স্কুল-কলেজের নিয়মিত পাঠদান। এইচএসসি পরীক্ষাসহ সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাতেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। হরতাল-অবরোধে তাৎক্ষণিক প্রভাবের চেয়ে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব শিক্ষার্থীদের ভোগাবে বলেই মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে লক্ষ্যবস্তু করে হরতাল-অবরোধ দেওয়া হচ্ছে। ফলে শুধু এসএসসি নয়, গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাই এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এর আগেও রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫০০ স্কুল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ সবই শিক্ষাবিরোধী কর্মকাণ্ড। সম্মিলিতভাবে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো উচিত।
তিনি বলেন, অন্যান্য দেশে আন্দোলন হয়, কিন্তু শিক্ষার ক্ষতি করে না। এ সবের ফল ভাল হয় না, এর সুদূরপ্রসারি প্রভাব পড়ে সবখানে।
এদিকে বর্তমান রাজনৈতিক কর্মসূচির ফলে শিক্ষার্থীরা মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ড. এম অহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ ১০ বছরের শিক্ষাজীবন শেষে প্রধান পরীক্ষা হিসেবে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে এ সব শিক্ষার্থীর ওপর মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। অনেকেই অসুস্থ ও হতাশ হয়ে পড়ছে।
তিনি আরও বলেন, এ ক্ষতি ঘণ্টাভেদে হিসাব করা যাবে না। কারণ পরীক্ষার্থীরা সবাই তরুণ-তরুণী। তাদের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপ করা যাবে না। এটা নিঃসন্দেহে সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা ও দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে।
অন্যান্য সময় পরীক্ষাকে রাজনীতির আওতামুক্ত রাখা হতো উল্লেখ করে ড. এম অহিদুজ্জামান বলেন, কিন্তু এখন শিক্ষাকে জিম্মি করে কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে। ফলে ১ জানুয়ারি বই বিতরণ, ফেব্রুয়ারির শুরুতে এসএসসি পরীক্ষা, এপ্রিলের শুরুতে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের যে শৃঙ্খলায় দেশ এগোচ্ছিল তাতে বড় ধরনের আঘাত পড়বে। গোটা ব্যবস্থাতেই দেখা দিবে বিশৃঙ্খলা।
এ বিষয়ে বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, শিক্ষাকে লক্ষ্যবস্তু করে রাজনীতি করা উচিত না। কারণ সবার সন্তানই শিক্ষার্থী। এর ক্ষতি হবে অপরিমেয়। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় যে ধরনের ধারবাহিকতা এসেছিল, তা নষ্ট হয়ে যাবে। এর সাথে শুধু আজকের পরীক্ষার সম্পর্ক বিদ্যমান নয়, প্রতিটি স্কুল-কলেজ, অন্যান্য পরীক্ষা, শিক্ষার সময়সূচি সবকিছুতে বাজে প্রভাব ফেলবে। এটাকে একটি দেশের জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত বলা যায়।
এ বিষয়ে দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর আহমেদ হোসেন বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে রাজনীতি করা ঠিক হচ্ছে না। এটা পুরো কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
সরকারি বাঙলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর এস এম মকফুর হোসেন এ বিষয়ে বলেন, একটা দুর্যোগকালীন সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। এতে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি হচ্ছে। তাদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। আর কোনো বিষয় যখন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে চলে আর সেখানে কোন ছেদ পড়ে তাতে ক্ষতি হয় অনেক বেশি। তাৎক্ষণিকভাবে হয়ত এটা বুঝা যাবে না, কিন্তু পরে অনুধাবণ হবে।
রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্মুখীন হবেন বলে মনে করছেন শিক্ষামন্ত্রীও। শুক্রবার পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, হরতালের মূল উদ্দেশ্য পরীক্ষা প্রতিহত করা। আর আজ যারা পরীক্ষা দিচ্ছে তারাই আগামী ৩০-৪০ বছর পর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু হরতালের কারণে পরীক্ষা পেছালে তাদের আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি দেখা দেয়।
এদিকে শুক্রবার প্রথম পরীক্ষা দিতে এসে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও উদ্বেগ-উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছেন। রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে যেমন ব্যাঘাত ঘটেছে, তেমনি এসএসসি পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার কথাও জানিয়েছেন তারা।
আজিমপুর সরকারি গার্লস স্কুল এ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের সামনে থাকা অভিভাবক সাবিনা আক্তার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘অনেকটা ভয়ের মধ্যেই সন্তানকে পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে এসেছি। কিন্তু দেশের যে অবস্থা তাতে পরবর্তী পরীক্ষাগুলো নিয়েও খুব চিন্তায় আছি।’
এদিকে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে পরীক্ষা দেওয়া মকবুল হোসেন পরবর্তী পরীক্ষাগুলো নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলেন, ‘রাজনীতিবিদরা এখন পরীক্ষা নিয়েও রাজনীতি শুরু করেছে। শুক্র, শনিবার করে পরীক্ষা দিলে পরীক্ষা যে কবে শেষ হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।’