সতর্ক সরকার: চলমান আন্দোলনে একাত্ম হতে পারেন প্রশাসনের বঞ্চিতরা
কোনো কাজ ছাড়াই ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করে বসিয়ে রাখা হচ্ছে প্রশাসনের শত শত কর্মকর্তাকে। একই সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তারা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন। এ জন্য প্রশাসনের বড় একটি অংশের কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা রয়েছে, রয়েছে সরকারের প্রতি ক্ষোভ।
সংশ্লিষ্টদের অনেকে বলছেন, বিএনপি জোটের জোরদার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে একাত্ম হয়ে আগামী দিনগুলোতে এ সব বঞ্চিত কর্মকর্তারা প্রশাসনে সরকারের প্রতিকূলে নিজেদের ভূমিকা রাখতে পারেন। অতীতে এর উদাহরণ রয়েছে। সর্বশেষ রবিবার দুপুরে সচিবালয় থেকে সরকার ও শেখ হাসিনা বিরোধী লিফলেট উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের যে কক্ষ থেকে লিফলেট উদ্ধার করা হয়েছে, সে কক্ষের চার কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও আটক করে পুলিশ। আটকদের ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে। এর আগেও গত কয়েক মাসে সচিবালয়ে সরকার বিরোধী লিফলেট বিতরণের চেষ্টা হয়েছে।
গত ৪ ডিসেম্বর রাতে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে কিছু সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে একজন যুগ্মসচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ও কয়েকজন কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছে সরকার।
বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে প্রশাসনের বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছে সরকার। নজরদারি জোরদারের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনকে আরও নিজেদের অনুকূলে নিতে তিন স্তরে পদোন্নতির প্রস্তুতিও চূড়ান্ত পর্যায়ে রেখেছে বলে জানা গেছে। সহসাই সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব, উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব ও যুগ্মসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির তালিকা প্রকাশ করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু রাজনৈতিক কারণে প্রশাসনে কর্মকর্তাদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে রাখা হচ্ছে। রাজনৈতিক পরিচয়ের তকমা লাগিয়ে পদোন্নতি বঞ্চনার বিষয় তো আছেই। আইনসম্মত না হলেও এ কর্মকর্তাদের সরকারবিরোধী শিবিরে যুক্ত হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও টিআইবির (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘কেউ দিনের পর দিন বঞ্চিত হলে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, এটা অস্বাভাবিক নয়। তবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মীচারীদের কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া ঠিক নয়।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানের ওএসডি প্রথা ও রাজনৈতিক পরিচয়ে মেধাবীদের পদোন্নতি বঞ্চিত রাখা অন্যায়। এগুলো বন্ধ হওয়া উচিত।’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়ানোর অতীত ইতিহাস আছে। তবে সেটা করা উচিত হবে না, আইনসম্মত হবে না।’
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘প্রশাসন যথাযথভাবে চলছে। এখানে কোনো সমস্যা নেই।’
১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চ গঠনের মধ্য দিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৯৬ সালে বিসিএস প্রশাসন এ্যাসোসিয়েশনের যারা নেতৃত্বে ছিলেন তারাই সরকারবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের এক পর্যায়ে জনতার মঞ্চ প্রতিষ্ঠায় সরাসরি সহায়তা করেন। মনে করা হয়, ’৯৬-এর নির্বাচনে প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। নির্বাচনে বিএনপি হেরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগও তুলেছিল ওই সময়। গত চারদলীয় জোট সরকারের সময়েও প্রশাসনে ব্যাপক হারে দলীয়করণ হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গত ৫ ফেব্রুয়ারির তথ্য অনুযায়ী, প্রশাসনে ৫৩৭ জন কর্মকর্তা ওএসডি রয়েছেন। সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন ৭৪ জন। এরমধ্যে ওএসডি চার জন। ২৪২ জন অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে ওএসডি ২০ জন। ওএসডি কর্মকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছেন যুগ্মসচিব। বর্তমানে ২২২ জন যুগ্মসচিব ওএসডি রয়েছেন। প্রশাসনে যুগ্মসচিব রয়েছেন ৮৭৫ জন।
এ ছাড়া এক হাজার ২৮৩ জন উপসচিবের মধ্যে ৯৩ জন ওএসডি। ওএসডি সিনিয়র সহকারী সচিবের সংখ্যা ১৩৩ জন। মোট সিনিয়র সহকারী সচিবের সংখ্যা এক হাজার ৫৯৮ জন। এক হাজার ২৩২ জন সহকারী সচিবের মধ্যে ৬৫ জন ওএসডি রয়েছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ওএসডি কর্মকর্তাদের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অধ্যয়নসহ নানা কারণে ওএসডি রয়েছেন। বাকি ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ কর্মকর্তা কোনো কারণ ছাড়াই গত প্রায় ৫ বছর ধরে ওএসডি রয়েছেন।
এদের বেশির ভাগই গত মহাজোট সরকারের শুরু থেকে ওএসডি আছেন বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। অনেকে ওএসডি অবস্থা থেকেই বিদায় নিয়ে চাকরির মেয়াদ শেষ করেছেন।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন গত মহাজোট সরকারের সময়ে বেশ কয়েকবার বড় ধরনের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকবারই কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বঞ্চনার অভিযোগ ওঠে। ওই সময়ে ওএসডি ও পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা কয়েকবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলেও সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে তা ভেস্তে যায়। সুযোগ পেলে কিংবা প্রেক্ষাপট তৈরি হলে বঞ্চিতরা অস্থিরতা তৈরির মাধ্যমে প্রশাসনে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে।
অবরোধ কর্মসূচি ও নাশকতা, সহিংসতার মধ্যে সচিবালয়ে কর্মকাণ্ড স্বাভাবিকভাবে চললেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কথাবার্তা কিংবা আচার-আচরণে সতর্কতা অবলম্বন করছেন তারা। কি বলে, কি করে আবার কোন বিপদে পড়ে যান- এই ভয়ে আছেন অনেকে। বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বললে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন- সামনে আসলে কি হবে?
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তিতে ৫ জানুয়ারি সাবেক প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয়। দিনটিকে কেন্দ্র করে বিএনপি রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে। সরকার কর্মসূচি পালন করতে না দেওয়ায় ৬ জানুয়ারি থেকে দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচির ডাক দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সেই থেকে এখনো অবরোধ চলছে। মাঝে মাঝেই হরতাল দেওয়া হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। এ পর্যন্ত সহিংসতায় অর্ধ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে।