সহিংস এলাকায় এখনো পৌঁছাননি আ’লীগের অধিকাংশ এমপি
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশের পরও দলের অধিকাংশ সংসদ সদস্য নিজ নির্বাচনী এলাকায় না গিয়ে ঢাকায় অবস্থান করছেন। বিশেষ করে যে সকল এলাকায় সহিংস ঘটনা বেশি ঘটেছে সে সকল এলাকার সংসদ সদস্যরা এখনও নির্বাচনী এলাকায় পৌঁছাননি।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ-হরতালে সংঘটিত সহিংসতা মোকাবেলায় দশম সংসদের পঞ্চম অধিবেশন মুলতবি করে সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় যাওয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সে নির্দেশনা মেনে অধিকাংশ এমপিই (সংসদ সদস্য) নিজ এলাকায় পৌঁছাননি। দ্য রিপোর্টের তথ্যানুসন্ধানে এ চিত্রই পাওয়া গেছে। বেশকিছু এলাকার চিত্র নিচে দেওয়া হল :
কুমিল্লা জেলা : কুমিল্লা জেলার ১১টি সংসদীয় আসনের ২টি জাতীয় পার্টি ও ২টি স্বতন্ত্র ছাড়া বাকী ৭টিতেই রয়েছে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য।
আওয়ামী লীগের কুমিল্লা-১ আসনের এমপি মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া এখনও ঢাকায় অবস্থান করছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক হওয়ায় কুমিল্লা-৫ আসনের এমপি আব্দুল মতিন খসরুও ঢাকায় অবস্থান করছেন। কুমিল্লা-৬ আসনের আ ক ম বাহাউদ্দিন, কুমিল্লা-৭ আসনের এমপি অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ, কুমিল্লা-৯-এর মো. তাজুল ইসলাম, কুমিল্লা-১০-এর আ হ ম মুস্তফা কামাল, কুমিল্লা-৩ আসনের ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন (স্বতন্ত্র), কুমিল্লা-৪ এর এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল (স্বতন্ত্র) চৌদ্দগ্রামে বাসে পেট্রোলবোমা হামলার ঘটনার পর এলাকায় যাননি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, জাতীয় পার্টির ২ জন ও আওয়ামী লীগের ১ জন এমপি ছাড়া আর কোনো সংসদ সদস্যই এখন এলাকায় নেই। এই তিন এমপি হচ্ছেন কুমিল্লা-১১-এর মো. মুজিবুল হক, কুমিল্লা-২ আসনের মোহাম্মদ আমির হোসেন (জাতীয় পার্টি)ও কুমিল্লা-৮ আসনের এমপি নূরুল ইসলাম মিলন (জাতীয় পার্টি)।
এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক এমপি দ্য রিপোর্টকে বলেন, সাধারণ মানুষ বোমাবাজি-মানুষ হত্যাকে ঘৃণা করে। ইউনিয়ন পর্যায়ে সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি করা হয়েছে। আমি এই মুহূর্তে ঢাকায়। চৌদ্দগ্রামে নৈশকোচে পেট্রোলবোমা হামলায় ৮ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পর থেকে নিয়মিতই কুমিল্লায় আসা-যাওয়া করছি।
রংপুর জেলা : রংপুর জেলার ৬টি সংসদীয় আসনের ২টিতে জাতীয় পার্টি ও ৪টিতে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রয়েছে। রংপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা ঢাকায় অবস্থান করছেন। রংপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভারতে ব্যক্তিগত সফর শেষে এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। এ ছাড়া রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এ্যাসোসিয়েশনের কাজে লন্ডনে অবস্থান করছেন। রংপুর-২ আসনের আবুল কালাম মো. আহ্সানুল হক চৌধুরী (আওয়ামী লীগ) গত বৃহস্পতিবার রাতে নির্বাচনী এলাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। রংপুর-৪ আসনের এমপি টিপু মুনশি (আওয়ামী লীগ) শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ঢাকাতে অবস্থান করছেন।
রংপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এইচএন আশিকুর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সহিংসতা মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছে না। মানুষ পারলে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়েছে। সংসদ অধিবেশন মুলতবি হয়েছে। এলাকায় এর মধ্যে ২ বার গিয়েছি। যাওয়া-আসার মধ্যেই আছি।’
রংপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য টিপু মুনশি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমি এখনো ঢাকায় আছি। এ সপ্তাহের শেষের দিকে এলাকায় যাব। আমার এলাকায় তো কোনো সমস্যা নেই। আর এসএসসি পরীক্ষার সময় থাকব।’
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দলের নেতা-কর্মীরা এলাকায় বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করছেন। আমার সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ হয়।
বগুড়া জেলা : বগুড়া জেলার ৭টি সংসদীয় আসনের ৪টিতে রয়েছে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য, ১টিতে জাসদ ও বাকী ২টিতে আওয়ামী লীগ।
বগুড়া-১ আসনে আওয়ামী লীগের এমপি আব্দুল মান্নান, বগুড়া-২ আসনে জাতীয় পার্টির শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ্, বগুড়া-৬ আসনের জাতীয় পার্টির এমপি মো. নূরুল ইসলাম ওমর ছাড়া আর কোনো এমপি এখনও নির্বাচনী এলাকায় যাননি।
আওয়ামী লীগের বগুড়া-৫ আসনের এমপি মো. হাবিবর রহমান, বগুড়া-৩ আসনে জাতীয় পার্টির মো. নূরুল ইসলাম তালুকদার, বগুড়া-৭ আসনে জাতীয় পার্টির মুহম্মাদ আলতাফ আলী, বগুড়া-৪ আসনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) এমপি এ.কে.এম. রেজাউল করিম তানসেন নির্বাচনী এলাকায় যাননি।
স্থানীয়রা জানান, সংসদ সদস্যরা এলাকায় গেলেও শহরের বাসভবনেই থাকেন। নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় যান না।
বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমরা তৎপর আছি। প্রতিদিনই মিছিল-সমাবেশ করছি। অন্যান্য এলাকা থেকে বগুড়া অনেক ভালো আছে। সংসদ সদস্যদের খবর তো আমরা জানি না। আমি জেলা সভাপতি হিসেবে যা করার তাই করছি। প্রতিরোধ কমিটি আর কী করব? আমাদের এখানে ১৪ দলের শরিক ২ দল আছে। জাসদ আর বাসদ। তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা একসঙ্গেই আছি।’
বগুড়া সদর আসনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম ওমর সংসদ মুলতবি হলেও এখনও এলাকায় যাননি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ব্যক্তিগত সহকারী মনি সরকার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘উনি একটু ব্যস্ত আছেন, কাল সকালে যোগাযোগ করেন।’ এলাকায় যাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দেশের যে অবস্থা এলাকায় যাবেন কী না আমি বলতে পারছি না।’
তবে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার নুরুল ইসলাম ওমর নিজ নির্বাচনী এলাকায় গিয়েছিলেন।
যশোর জেলা : যশোর জেলার ৬ সংসদীয় আসনের মাত্র ১টি স্বতন্ত্র ছাড়া বাকী ৫টিতেই রয়েছে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য।
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক মীর জহুরুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে জানান, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য যশোর-১ শেখ আফিল উদ্দিন, যশোর-২ মো. মনিরুল ইসলাম, যশোর-৪ রণজিত কুমার রায় এখন এলাকায় অবস্থান করছেন।
এ ছাড়া যশোর-৩ এর এমপি কাজী নাবিল আহমেদ, যশোর-৬ এর এমপি ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক এখনও নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় যাননি। এ দিকে যশোর-৫ আসনের স্বতন্ত্র এমপি স্বপন ভট্টাচার্য্যও ঢাকায় অবস্থান করছেন।
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সংসদ সদস্যদের এখনও আমাদের চোখে পড়েনি। আমাদের জিজ্ঞেস না করে সংসদ সদস্যদের জিজ্ঞেস করুন। সারা দেশের যে কোনো জেলার চেয়ে যশোরের অবস্থা ভালো। এখানে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা পলাতক। তারা মিছিল করতে পারে না। আমার জেলায় এইগুলো চলবে না। আমাদের উপর থেকে নির্দেশ আছে আগুন দেওয়ার সময় কাউকে পাওয়া গেলে তাদের পুড়িয়ে দিতে। আন্দোলনকারীরা বাঁশি বাজালেই তো সংসদ সদস্যরা পালিয়ে যাবে। তাদের আসার কি দরকার।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক সাংগঠনিক সম্পাদক দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সংসদ সদস্যরা এলাকায় যাওয়ার পরই পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে দল।’
তবে এই সাংগঠনিক সম্পাদক দাবি করেন, সংসদ সদস্যরা যেখানেই থাকুক তারা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে।
এ বিষয়ে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন ও কাজী জাফরউল্লার কাছে জানতে চাইলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।