সরকারে ‘অসহিষ্ণুতা’ বাড়ছে
রাজনৈতিক অস্থিরতায় জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। সরকারের অনেক মন্ত্রী দাবি করছেন সবকিছু স্বাভাবিক চলছে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি উল্টো। সরকার আশ্বাস দিলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না। এমন অবস্থায় সরকার এবং পুলিশ প্রশাসনের বক্তব্য আরও উত্তাপ ছড়াচ্ছে। পুরো এ বিষয়টিকে সরকারের ‘অসহিষ্ণুতা’ বাড়ার লক্ষণ বলে মনে করছেন রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় আসার পর সরকার ও দলের বিভিন্ন স্তর থেকে বিভিন্ন সময়ে সুশীল সমাজকে দোষারোপ করে বক্তব্য এসেছে। এর আগে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ সব প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কিন্তু গত শনিবার ‘নাগরিক ঐক্য প্রক্রিয়া’র উদ্যোগে অনুষ্ঠিত একটি গোলটেবিল আলোচনায় আলোচিত বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে সরকারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ জানান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
সাধারণত সুশীল সমাজের কোনো আলোচনা সভার পরিপ্রেক্ষিতে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ জানানোর ঘটনা প্রায় বিরল। ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একাধিকবার রাজনৈতিক সঙ্কট (৫ জানুয়ারির নির্বাচনসহ) দেখা দিয়েছে। তার কোনোটাতেই ‘নাগরিক ঐক্য প্রক্রিয়া’র মতো এতবড় আকারে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা একসঙ্গে বসেননি। তাই এই বিষয়টাকে স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবেই মনে করছে সরকার।
স্পর্শকাতরতার বিষয়টি স্বীকার করে সুজনের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘স্পর্শকাতর বিষয় তো বটেই। দেশের এতজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যখন এক টেবিলে বসেন তখন সেটাকে কেউ স্পর্শকাতর ভাবতেই পারেন। তবে সরকারের তথ্যমন্ত্রী যে সব কথা বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সেই স্বাধীনতা তার আছে। আমরাও স্বাধীনতা নিয়ে আমাদের কাজ করে যাচ্ছি।’
সাবেক মন্ত্রী ও বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী বলেন, ‘সমস্যার সঠিক জায়াগায় পদক্ষেপ না নিলে সরকারের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করবে, ভুল সিদ্ধান্ত নেবে এবং ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে। বর্তমান সরকারের লক্ষণে এই বিষয়গুলো দেখা যাচ্ছে।’
পর্যবেক্ষকদের মতে, বিরুদ্ধে বললে তো বটেই, পরামর্শমূলক কিছু বললেও সহ্য করতে পারছে না সরকার। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্যে তারই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠছে। সাধারণ মানুষ, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ীসহ দেশী-বিদেশী প্রায় সকল জায়গা থেকে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান আসছে। কিন্তু সংলাপের বিষয়টি বরাবরই নাকচ করছে সরকারপক্ষ।
রবিবার তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সংলাপের আহ্বান জানানো নাগরিক সমাজের তুমুল সমালোচনা করে তাদের অবস্থানকে প্রকারন্তরে ‘বিএনপির নাশকতাকে সমর্থন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। একই দিনে আরেক ধাপ এগিয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সুশীল সমাজকে ক্যান্সার আখ্যায়িত করে তাদের সমাজ থেকে উচ্ছেদ করার কথা বলেন। অভিযুক্ত করেন হত্যার ইন্ধনদাতা হিসেবেও।
বর্তমান অবস্থার জন্য প্রায় সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের ত্রাহি অবস্থা। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক সমঝোতার দিকে তাকিয়ে আছে মানুষ। তবে সরকার একে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে স্বীকার করতে নারাজ। সরকার ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সহিংস পরিস্থিতিকে সন্ত্রাসবাদী সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করছেন। প্রশাসনিকভাবেই এর সমাধান খুঁজছেন।
বিএনপি বলছে সহিংসতার জন্য সরকার দায়ী, অপরদিকে সরকার দায়ী করছে বিএনপিকে। দুই দলই যখন সহিংস ঘটনাকে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য দোষারোপ করছে তখন এই সমস্যা সমাধানের দায় কার? হাসানুল হক ইনুর কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘যারা আন্দোলনের ডাক দিয়ে এ সব করছেন, দায় তাদের।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সরকার এখন দিশেহারা হয়ে গেছে, আবোল-তাবোল বকছে। বিএনপিকে ছেড়ে সুশীল সমাজসহ সাধারণ মানুষকেও প্রতিপক্ষ ভাবছে। মুখে যত কথাই বলুক, তারা জানেন জনগণ তাদের সঙ্গে নেই।’
সরকারের একাধিক মন্ত্রীর কথায় রাজনৈতিক সমালোচনা হলেও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে পুলিশ প্রশাসনের বড় কর্তাদের ‘রাজনৈতিক’ বক্তব্য। সম্প্রতি রংপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবিপ্রধানসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তা সরকারদলীয় রাজনীতিবিদদের কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ক্ষেত্রে এমপি-মন্ত্রীদের রাজনৈতিক মন্তব্য হালকাভাবে নেওয়া হলেও প্রশাসনিক পর্যায় থেকে রাজনৈতিক বক্তব্য আসাকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হয়।
সর্বশেষ ঢাকা রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এ এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান গত শনিবার গাজীপুরের একটি অনুষ্ঠানে সহিংসতা রোধে পুলিশের যা যা করণীয় তাই করতে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হুকুম দিয়ে গেলাম। দায়-দায়িত্ব সব আমার।’ এর আগে প্রধানমন্ত্রী নিজের ওপর দায় নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের জন্য প্রায় সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ বিভিন্নভাবে আহ্বান জানাচ্ছেন। তা সত্ত্বেও সহিংসতায় যেমন মানুষ পুড়ছে, তেমনি অভিযোগ বাড়ছে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’র। প্রায় লাখ কোটি টাকার ক্ষতির হিসাব দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
দেশের ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ সংগঠন এফবিসিসিআই (ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ) রবিবার জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে জাতীয় সংঙ্গীত পরিবেশন করে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনটির সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট শিল্পপতি আনিসুল হক মন্তব্য করেছেন, ‘দেশ জ্বলছে আর নিরোরা বাঁশি বাজাচ্ছেন।’
নিজেদের নেওয়া উদ্যোগের (নাগরিক ঐক্য প্রক্রিয়া) বিষয়ে তথ্যমন্ত্রীর সমালোচনামূলক মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘তথ্যমন্ত্রী তো অনেক কথাই বলেন, তার কথায় আমরা কি-ই বা বলতে পারি। তার লাগামছাড়া অনেক কথা আসে, সব কথার জবাব দিতে হয় না।’