সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে পোস্টার ‘হিযবুত তাহরীরের প্রচারণা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসঙ্কেত’
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীর। সংগঠনটির এমন প্রচারণাকে গণতন্ত্র ও রাজনীতির জন্য অশনিসঙ্কেত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নিষিদ্ধ এ সংগঠনটির পোস্টারের মাধ্যমে প্রচারণায় রাজনীতি বিশ্লেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করলেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
দ্য রিপোর্টের অনুসন্ধানে জানা দেখা গেছে, রাজধানীর বিশেষ কয়েকটি স্থানে নিয়মিত হিযবুত তাহরীরের পোস্টার লাগানো হয়। এ সব স্থানের মধ্যে ঢাকা সিটি কলেজের উল্টাপাশে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (সায়েন্স ল্যাব) প্রাচীর, কাঁটাবন জামে মসজিদ এলাকা, ফার্মগেটের পূর্ব রাজাবাজার এলাকা, পান্থপথ এলাকা, কমলাপুর ও মতিঝিলের আশাপাশের বেশ কয়েকটি স্থানে নিয়মিত পোস্টারিং করছে সংগঠনটি। তবে এ সব এলাকায় কে বা কারা কখন পোস্টারিং করে তা স্থানীয়রা বলতে পারেননি। সম্প্রতি কমলাপুর এলাকার কমিশনার রোডের বেশ কয়েকটি বাড়ির দেয়ালে হিযবুত তাহরীরের কিছু পোস্টার লক্ষ্য করা যায়। এই রোডের এক মুদি দোকানদার শরিফুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত আমার দোকান খোলা থাকে। এ সময়ের মধ্যে এই রোডে অনেকেই পোস্টার লাগায়। কিন্তু হিযবুত তাহরীরের এই পোস্টারগুলো আমি কাউকে লাগাতে দেখিনি। হঠাৎ একদিন দোকান খোলার সময় দেখি পোস্টারগুলো লাগানো হয়েছে।’
ফিলিস্তিনের জেরুজালেমের শরীয়াহ আদালতের বিচারপতি শায়খ তাকী-উদ্দিন আন-নাবহানী ১৯৫৩ সালে হিযবুত তাহরীর প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও ধীরে ধীরে আফ্রিকা, ইউরোপ, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে হিযবুত তাহরীর। বাংলাদেশে ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এ দলটি তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জননিরাপত্তার স্বার্থে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে। এরপর সংগঠনটি আর প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারেনি।
সম্প্রতি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হিযবুত তাহরীর অগণতান্ত্রিক শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতা অধিগ্রহণের যে আহ্বান জানিয়েছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। একই সঙ্গে দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া না থাকায় যে কোনো মুহূর্তে অগণতান্ত্রিক শক্তির উদ্ভব হতে পারে বলেও মনে করছেন তারা।
সম্প্রতি এক পোস্টার প্রচারণায় হিযবুত তাহরীর দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের সমলোচনা করে সেনাবাহিনীর ‘নিষ্ঠাবান’ কর্মকর্তাদের সহযোগিতা কামনা করে তাদের রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানিয়েছে।
তবে হিযবুত তাহরীরের এমন প্রচারণাকে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের প্রচারণা বলে মনে করছেন সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী। অন্যদিকে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে হিযবুত তাহরীরের এমন প্রচারণা উদ্বেগজনক নয় বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। তবে নিষিদ্ধ এ সংগঠনটির সার্বিক কার্যক্রমের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সজাগ রয়েছে বলেও জানান তারা।
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হিযবুত তাহরীরের এমন প্রচারণায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নিরাপত্তা ও রাজনীতি বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম। তিনি বলেন, ‘হিযবুত তাহরীরের এমন প্রচারণা অবশ্যই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য হুমকি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই সংগঠনটি তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। তবে প্রচলিত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে তারা ভিন্ন ধারার শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আর এ কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারা সব সময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে পুঁজি করে তৃতীয় অর্থাৎ সেনাশক্তিকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় যেতে চায়। বাংলাদেশের চলমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থায় অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তৃতীয় শক্তির উদ্ভব নিয়ে। অনেকে আশঙ্কা করছেন এমন পরিস্থিতি তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতা গ্রহণে উৎসাহিত করবে।’
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘হিযবুত তাহরীরের এমন পোস্টার উদ্বেগজনক কিছু না। এ সংগঠনটি শুধু বাংলাদেশে না বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত। তারা সব সময় রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ডের সমালোচনার মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। সাম্প্রতিক সময়ে হিযবুত তাহরীরের পোস্টার আমাদের নজরে এসেছে। এ পোস্টারটিতে সংগঠনটি দেশের প্রধান দুটি দলের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড তুলে ধরেছে। এর মাধ্যমে তারা জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে।’
তিনি বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই হিযবুত তাহরীরের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে আমরা সজাগ রয়েছি। তাদের ব্যাপারে আমরা কোনো তথ্য পেলেই আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে তাদের এমন প্রচারণায় উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, কারণ তারা এখন সাংগঠনিকভাবে ততটা সবল নয়।’
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা নিয়ে চিন্তিত রয়েছি। এ মুহূর্তে হিযবুত তাহরীরের ব্যাপারে ভাবার সময় নেই। আর নিষিদ্ধ একটি সংগঠন কিভাবে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতায় আহ্বান করে বা তাদের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, তা আমার চাইতে আইনমন্ত্রী ভাল বলতে পারবেন।’
তবে এ বিষয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ ব্যাপারে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, ‘হিযবুত তাহরীর আর খালেদা জিয়ার মনের কথা এক। খালেদা জিয়া তো আন্দোলনের নামে নাশকতা করছে তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় আনার জন্য। খালেদা জিয়া গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নন। তিনি চান তৃতীয় শক্তি তাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিক। বিএনপির জন্ম হয়েছে সেনা ছাউনিতে। তারা সব সময় সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসতে চায়।’
হিযবুত তাহরীরের এমন প্রচারকে গণতন্ত্র ও দেশের রাজনীতির জন্য অশনিসঙ্কেত বলে মনে করছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘উদ্বেগের বিষয় হলো একটি নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন কিভাবে এমন প্রচারণা চালায়। তাদের এমন প্রচারণা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার কিছু নেয়। দেশের কিছু অসাধু মহল রয়েছে যারা এমন প্রচারণার মাধ্যমে একটি অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে চায়।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দেশে যে সঙ্কট চলছে তা রাজনৈতিক, আর এমন সঙ্কটের সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। গণতন্ত্রের বিকল্প কেবল গণতন্ত্র। বর্তমান পরিস্থিতিতে কখনই সেনা হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এ ধরনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে পুঁজি করেই সেনাবাহিনী বারবার বাংলাদেশের ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেকটা ভিন্ন। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের জনগণ সেনা ক্ষমতা চায় না।’