সুনসান নীরবতা, নতুন সূর্যের অপেক্ষা
সোমবার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সুনসান নীরবতার চিত্র দেখে কে বলবে; মাত্র একদিন আগে এখানেই ফুটবলপ্রেমীরা উন্মাদনায় ভেসেছিল। রবিবার যে স্টেডিয়ামের মাঠে দেশের ফুটবলারদের পারফরম্যান্স উজ্জীবিত করেছে হাজারো ভক্তকে, গ্যালারি-আশপাশ লোকে লোকারণ্য হয়েছে, সেই স্টেডিয়ামেই সোমবার নিথর নীরব। মামুনুলদের বীরোচিত পারফরমেন্সের স্মৃতি নিয়ে এখন শূন্য মাঠ-গ্যালারি, বাইরে নিত্য কাজে ব্যস্ত হাজারো মানুষের পদচারণা ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ দিয়ে ফিরে পাওয়া ফুটবলের নব জাগরণের লেশমাত্র নেই।
ভাবটা এমন, ১১ দিনের কোটি কোটি টাকার আসরটি যে ফুটবল আবেগের বন্যা হঠাৎ করেই বইয়ে দিয়েছিলে, আসরের ফাইনালে মালয়েশিয়ার কাছে বাংলাদেশের হারে সেই আবেগ হঠাৎ করেই মিইয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে আসলেই কী তা? না, ফুটবলের এ নবজাগরণ শেষ হয়ে যায়নি; হারলেও ফাইনালে মামুনুলদের বীরোচিত খেলা ফুটবলের জনপ্রিয়তায় যে ঢেউ তুলেছে তা অটুট রয়েছে। দেশের ফুটবলে আবার নতুন সূর্যের মুখ দেখার প্রত্যাশা ভর করেছে। আর তাই তো সামনের দিনগুলোতে ফুটবলকে সাফল্যের কাঙ্খিত সিঁড়িতে টেনে নিতে সোমবার কোচ ক্রুইফের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কিংবা বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের নিয়মিত আয়োজন করার বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। অন্যদিকে, ফুটবলাররাও স্বপ্ন বুনছেন সামনের দিনগুলোতে নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার।
অপরাজিত দল হিসেবেই রবিবার বাংলাদেশকে হারিয়ে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের শিরোপা জিতে নিয়েছে মালয়েশিয়া অনুর্ধ-২৩ দলটি। মঙ্গলবার দেশে ফিরে যাবে তারা। সঙ্গে নিয়ে যাবে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের শিরোপা। কিন্তু শিরোপা নিয়ে গেলেও বাংলাদেশের ফুটবলে নব জাগরণের আবেগটাকে ঠিকই সন্মান জানিয়ে যেতে হচ্ছে তাদের। তাই তো মালয়েশিয়ান দলের অধিনায়ক বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘ফাইনালের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশের ছেলেরা যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো, এক কথায় তা ছিলো অবিশ্বাস্য। আমরা ভাবতেও পারিনি তারা এমনভাবে ম্যাচে ফিরে আসবে। একটি থ্রো এবং এক কর্নারেই আমাদের স্বপ� ভেঙ্গে যাচ্ছিলো প্রায়। তবে ভাগ্য আমাদের সঙ্গে ছিলো বলেই শেষ পর্যন্ত আমরাই টিকে রইলাম। বাংলাদেশ বেশ ভালো ফুটবল উপহার দিয়েছে এই টুর্নামেন্টে। ফুটবলে তারা যে দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে তার প্রমান পাওয়া গেলো।’ শুধু কি তাই? নাজিরুল নাঈমের তরুণ অধিনায়ক বাংলাদেশের দর্শকদের নিয়েও বলেছেন, ‘বাংলাদেশ খুব ভালো ফুটবল খেলে। তারা আরো এগিয়ে যাবে বলেই আমার ধারণা। আর এখানকার দর্শকদের কথা কি বলবো? এক কথায় তাদের মাঝে অসাধারণ ফুটবল ক্রেজ দেখেছি আমরা।’ শিরোপা হারিয়েছে যে দলের কাছে সেই দলের অধিনায়কেই মুখেই বাংলাদেশ নিয়ে এমন মন্তব্য কি এদেশের ফুটবলের জয় নয়?
এক সময় ফুটবল বাংলাদেশে কতোটা জনপ্রিয় ছিল তা অতীতের অনেক ঘটনাতে প্রমাণ রয়েছে। স্রেফ মোহামেডান-আবাহনীর মতো দুই ক্লাবের ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে যে হৈ চৈ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো তা আদতে এ দেশে ফুটবল জনপ্রিয়তারই বহিঃপ্রকাশ ছিল। তবে সময়ের আবর্তনে ফুটবল চলে গেছে অন্তরালে। ক্রিকেট জায়গা করে নিয়েছে সেখানে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ক্রিকেটারদের সাফল্যের কারণে ফুটবলকে হঁটিয়ে ক্রিকেট হয়ে গেছে এ দেশের প্রধান জনপ্রিয় খেলা। তাই তো ক্রিকেট মাঠে যখন দর্শক সরগরম, তখন ফুটবল মাঠে শূণ্য গ্যালারি হয়ে গেছে বর্তমানের চিত্র। কিন্তু গত বছর বাংলাদেশ সফরে শ্রীলঙ্কা জাতীয় দল কিংবা জাপান অনুর্ধ-২৩ দলে ফু্টবল ম্যাচগুলোর পর বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে দর্শকদের উন্মদনা প্রমাণ করে দিয়েছে এ দেশে ফুটবলে জনপ্রিয়তা এখনও অটুট। কেবলমাত্র এই জনপ্রিয়তার বহিঃপ্রকাশের জন্য একটুখানি রসদ দরকার! এই আসরে দর্শকরা যেমন উন্মদনা দেখিয়েছেন সেই উন্মদনায় মামুনুলদের নিশ্চিতভাবে ভাল করতে উদ্ধুদ্ধ করেছে, দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধ করেছে। আর সে কারণেই তো ফাইনালে হেরে যাওয়ার পর কেঁদেছেন ফুটবলাররা।
শিরোপা জিততে না পারায় নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন জাহিদ হাসান এমিলি। কষ্টে করে স্টেডিয়ামে আসা দর্শকদের শিরোপা আনন্দ উপহার দিতে না পারায় অনুশোচনায় ভুগেছেন সোহেল রানা। মানসিক পীড়ায় মধ্যরাতে ফেসবুকে ওয়াহেদের স্ট্যাটাস, ‘ঘুমাতে পারছি না।’ তবে যন্ত্রণার মধ্যেও আগামীতে সাফল্যে বগলদাবা করার স্বপ্নও আছে। আর সেই কারণেই হয়তো বা হেমন্ত বিশ্বাস ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘সেমিফাইনাল ম্যাচটি খেলেছিলাম নিজেদের জন্য। আর ফাইনাল ম্যাচটি ছিল দেশবাসীর ভালোবাসার প্রতি সম্মান। চেষ্টা করেছিলাম। পারলাম না। আপনারা সাথে থাকলে আশা করি পরের বার হয়ে যাবে।’