খালেদা জিয়ার দিন-রাত্রি
গত ৩৭ দিন গুলশানে নিজ কার্যালয়ে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এর মধ্যে গত ১২ দিন কার্যালয়ের টেলিফোন ও ফ্যাক্স সংযোগ, ইন্টারনেট, ডিশ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ফলে খালেদা জিয়া বাইরে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। এমন অবস্থায় বিশ্রাম, নামাজ, দোয়া-দরূদ, পত্র-পত্রিকা ও বই পড়ে সময় কাটছে তার।
বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে অবস্থানকারী প্রেস উইংয়ের সদস্য শামসুদ্দিন দিদার বলেন, ‘ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান ও মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরীন সুলতানার সঙ্গেও ম্যাডাম দীর্ঘসময় কাটছে। এ ছাড়া কার্যালয়ে অবস্থানরত নেতা ও স্টাফদের সঙ্গে পারিবারিক আলাপ করেও ম্যাডাম সময় পার করছেন।’
গুলশান কার্যালয় সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার দিন শুরু হয় ফজর নামাজের মধ্য দিয়ে। এরপর তিনি সকালের নাশতা করেন। তার পর বেশ কয়েকটি জাতীয় পত্রিকা পড়েন। কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে গোসল সেরে জোহরের নামাজ পড়েন। দুপুর আড়াইটার দিকে খাবার খেয়ে আবারও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। বিশ্রাম শেষে আছরের নামাজ পড়ে তিনি চা খান। এভাবে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি নফল নামাজও আদায় করেন খালেদা জিয়া।
টেলিফোন ও ফ্যাক্স সংযোগ, ইন্টারনেট, ডিশ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে পত্র-পত্রিকার ওপর নির্ভর করেই খালেদা জিয়াকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খবরা-খবর জানতে হচ্ছে। বাইরের সঙ্গে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর ইবাদত-বন্দেগিতেই বেশী সময় পার করছেন তিনি।
গত ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর নিজের কার্যালয়ে প্রবেশ করেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ওইদিন রাতেই দলের যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে নয়া পল্টনে যেতে চাইলে খালেদা জিয়া পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। কয়েক শ’ পুলিশ সেদিন রাতে তাকে কার্যালয় থেকে বের হতে বাধা দেয়। পরদিন কার্যালয়ের মূল গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয় পুলিশ। একই সঙ্গে কার্যালয়ের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। রাস্তায় এলোপাতাড়িভাবে প্রথমে ইট, বালুভর্তি ১৩টি ট্রাক, পরে আরও কয়েকটি যুক্ত করে মোট ২১টি ট্রাক দিয়ে চলাচলের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সে থেকেই খালেদা জিয়া কার্যালয়ে ‘অবরুদ্ধ’ হয়ে পড়েন।
এরপর ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ উপলক্ষে কালোপতাকা মিছিল কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে বের হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করে। এতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কর্মসূচি পালনে বাধা পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা দেন।
সেদিন থেকেই খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ে টানা অবস্থান করে আন্দোলনের কর্মসূচি ও সার্বিক দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। এরই মধ্যে গত ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়াতে বসবাসকারী চিকিৎসাধীন ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা যান। ছেলের মৃত্যুতে কয়েক দিন কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় একটি কক্ষে তিনি একাকী অবস্থান করেন। নিকটাত্মীয় ছাড়া কারো সঙ্গেই তিনি দেখা করেননি।
গত ৩০ জানুয়ারি মধ্যরাতে কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় তাকে কয়েক ঘণ্টা মোমের আলোতেও কাটাতে হয়েছে। পরদিন কার্যালয়ের ক্যাবল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট, টেলিফোন, ফ্যাক্স সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ২০ ঘণ্টা পর বিদ্যুৎ পুনঃসংযোগ দেওয়া হলেও এখনো বিচ্ছিন্ন রয়েছে অন্যান্য সংযোগ।
গত সপ্তাহ থেকে খালেদার গুলশান কার্যালয়ের ভেতর পরিবারের কয়েকজন সদস্য ছাড়া অন্য কাউকেই প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। একই সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার থেকে কার্যালয়ের গেটে চেয়ার-টেবিল নিয়ে অবস্থান নিয়েছে স্পেশাল ব্রাঞ্চের তিন সদস্য। খোলা হয়েছে রেজিস্টার খাতা। কেউ প্রবেশ করতে চাইলে বা কার্যালয় থেকে বের হলেই তার নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর, যোগাযোগের ঠিকানা, স্বাক্ষরসহ বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে।
গুলশান কার্যালয়ে থাকা কয়েকজন নেতাকর্মী ও স্টাফের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খালেদা জিয়ার বড় বোন সেলিমা ইসলাম, দুই ভাবী ও তাদের সন্তান ছাড়া কাউকেই তার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। দেখা করতে দলের কোনো সিনিয়র নেতা ও সাধারণ কর্মীরা কার্যালয়ের সামনে এলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বাধায় তারা চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এদিকে, কার্যালয়ের নিরাপত্তার জন্য রবিবার সকালে সীমানা প্রাচীরের উপর কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছেন ভবনের মালিক।
সোমবার (৯ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা পর্যন্ত খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিনা ইসলাম ও ভাইয়ের বউ নাসরিন সাঈদ, কানিজ ফাতেমা, বড় ছেলে তারেক রহমানের স্ত্রীর বড় বোন শাহিনা খান জামান বিন্দু ছাড়া বাইরের কাউকেই ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন চেয়ারপারসন অফিসের কর্মকর্তারা। অবশ্য এর আগে রবিবার রাতে দলের প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের দুই মেয়ে দেলোয়ারা বেগম লুনা খন্দকার ও জাহানারা বেগম পান্না অনুমতি নিয়ে দেখা করতে পেরেছিলেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে অবস্থানকারী প্রেস উইংয়ের সদস্য শামসুদ্দিন দিদার বলেন, ‘স্পেশাল ব্রাঞ্চের খাতা নিয়ে গেটে বসার পর থেকে ম্যাডামের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে কোনো নেতাকর্মী কার্যালয়ে প্রবেশ করতে পারেননি। একান্তই নিজের কয়েকজন স্বজন মাঝে মাঝে আসেন। বাকি সময় তিনি একা একাই নামাজ, দোয়া-দরূদ, পত্র-পত্রিকা ও বই পড়ে সময় কাটান। কার্যত তিনি সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছেন।’
প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ম্যাডাম সুস্থ আছেন। তিনি সকলের দোয়া চেয়েছেন।’
দলের চেয়ারপারসনের ‘অবরুদ্ধ’ অবস্থা সম্পর্কে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘গুলশানের কার্যালয়ে আমরা কেউই বেগম জিয়ার কাছে যোগাযোগ করতে পারছি না। তার টেলিফোন, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট সব কিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার কার্যালয়ের গেটের সামনে পুলিশ রেজিস্টার বই খুলে বসেছে। এখন নেতাদের কাউকে সাক্ষাৎ পর্যন্ত করতে দেওয়া হচ্ছে না। বেগম খালেদা জিয়া কি গ্রেফতার, অবরুদ্ধ, না মুক্ত আছেন, তা সরকারকে পরিষ্কার করতে হবে।’
দলের যুগ্ম-মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অঘোষিত কারাগারে রুদ্ধ করে রেখেছে অবৈধ সরকার। গদি রক্ষার জন্যই সরকার এ অবস্থা করে রেখেছে। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন কোনোদিনই পূরণ হবে না। গণআন্দোলনের বিজয়ের মধ্যদিয়েই জনগণ প্রিয় নেত্রীকে মুক্ত করবেই।’